আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ: ব্ল্যাক হোল কীভাবে কাজ করে ? মহাবিশ্বের অন্যতম রহস্যময় এবং আকর্ষণীয় বিষয় হলো ব্ল্যাক হোল। প্রায়শই এটি বিজ্ঞানের সিনেমা বা কল্পকাহিনীতে এক রহস্যময় প্রাণী বা মহাশক্তির রূপে দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবে ব্ল্যাক হোল এমন একটি স্থান যেখানে মহাবিশ্বের সব ধরনের শক্তি, আলো এবং পদার্থ যেন মগ্ন হয়ে যায়। তাহলে, ব্ল্যাক হোল আসলে কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে? চলুন, এটি নিয়ে বিস্তারিত জানি।
ব্ল্যাক হোল কী?
ব্ল্যাক হোল (Black Hole) হল মহাবিশ্বের এমন একটি অঞ্চল যেখানে পৃথিবী বা অন্য কোনো স্থানে আলো বা পদার্থের কোনো কিছু প্রবাহিত হতে পারে না, কারণ সেই স্থানে এমন এক শক্তিশালী মধ্যাকর্ষণ (gravity) কাজ করে যা আলোকিত তেজস্বরূপ অতিরিক্ত শক্তি শোষণ করে। সাধারণত ব্ল্যাক হোল তৈরি হয় যখন কোনো বিশাল মেঘের মতো বড় তারকার মৃত্যু ঘটে এবং তা গহ্বর বা একদম সংকুচিত অবস্থায় পরিণত হয়।
এটি হলো এমন একটি এলাকা যেখানে মহাকর্ষের শক্তি এতই প্রবল যে, কিছুই সেখানে প্রবেশ করতে পারে না, এমনকি আলোকরশ্মি (light) পর্যন্ত। এর ফলে এটি প্রায় অদৃশ্য হয়ে থাকে। যদিও এর অস্তিত্ব প্রায় সবসময়ই পরোক্ষভাবে প্রমাণিত হয়ে এসেছে, তবে আলবার্ট আইনস্টাইন তার রিজনেন্স থিওরি (Theory of Relativity) এর মাধ্যমে এর অস্তিত্বের অনুমান করেছিলেন।
ব্ল্যাক হোল কীভাবে তৈরি হয়?
ব্ল্যাক হোল মূলত তখন তৈরি হয় যখন কোনো বড় তারকা (যার ভর সূর্যের প্রায় ২০ গুণের বেশি) তার জীবনকালের শেষে শক্তি হারাতে শুরু করে। এর ফলে তার অভ্যন্তরীণ চাপ কমে যায় এবং এই তারকা সংকুচিত হয়ে তার নিজস্ব মহাকর্ষের তলদেশে পতিত হয়। এই অবস্থায় তার ভর এবং আকার এতটাই কমে যায় যে তার মহাকর্ষের শক্তি এত বেশি হয় যে, কিছুই তার প্রভাব থেকে বের হতে পারে না।
ব্ল্যাক হোলের বৈশিষ্ট্য:
১। ইভেন্ট হরাইজন (Event Horizon):
ব্ল্যাক হোলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল ইভেন্ট হরাইজন। এটি ব্ল্যাক হোলের সেই সীমা যা পেরিয়ে কোনো কিছু আর ফিরে আসতে পারে না। অর্থাৎ, একবার কিছু ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজন পেরিয়ে গেলে, সে আর বের হতে পারে না, এমনকি আলোও। একে “অদৃশ্য সীমা” বলা যেতে পারে।
২। সিঙ্গুলারিটি (Singularity):
ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। এটি এমন একটি স্থান যেখানে তারকা বা কোনো বস্তু সংকুচিত হয়ে একত্রিত হয়ে যায়। এই স্থানে স্থান এবং সময়ের ধারণা ভেঙে যায়, অর্থাৎ সাধারণ ধারণায় এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে মহাকর্ষের প্রভাব এত শক্তিশালী যে কোনো পদার্থ বা শক্তি সেখানে গিয়ে নিজেদের পরিসীমা হারিয়ে ফেলে। সিঙ্গুলারিটি সম্পর্কে আমাদের এখনো স্পষ্ট ধারণা নেই, তবে এটি মহাবিশ্বের অন্যতম গভীর রহস্য।
৩। অ্যাসিম্পটোটিক ইনফিনিটি (Asymptotic Infinity):
ব্ল্যাক হোলের সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল অ্যাসিম্পটোটিক ইনফিনিটি, যা বলা হয় একটি তাত্ত্বিক সীমা যেখানে প্রবাহিত বস্তু বা আলো ব্ল্যাক হোলের দিকে চলে যেতে থাকে, কিন্তু কখনো পৌঁছাতে পারে না। এই বৈশিষ্ট্যটি ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজন থেকে দূরের এলাকা যেখানে পৃথিবী বা অন্য কোনো বস্তু তার আচ্ছাদিত শক্তির বাইরে চলে যায়।
ব্ল্যাক হোলের ধরণ:
ব্ল্যাক হোলের প্রধান তিনটি ধরণ রয়েছে:
১। স্টেলার ব্ল্যাক হোল (Stellar Black Hole):
এই ব্ল্যাক হোলগুলি একটি বিশাল তারকা মারা যাওয়ার পর তৈরি হয়। তারা সাধারণত সূর্যের কয়েক গুণ বড় হয়। তারা অনেক শক্তিশালী এবং তাদের মহাকর্ষ এত প্রবল যে, কোনো কিছুই তাদের কাছ থেকে পালাতে পারে না।
২। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল (Supermassive Black Hole):
এই ব্ল্যাক হোলগুলি গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং তাদের ভর সূর্যের কোটি গুণেরও বেশি। ধারণা করা হয়, প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল থাকে। যেমন, আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল আছে, যা “সাগিটারিয়াস এ” নামে পরিচিত।
৩। ইন্টারমিডিয়েট ব্ল্যাক হোল (Intermediate Black Hole):
এই ব্ল্যাক হোলগুলি স্টেলার এবং সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের মাঝামাঝি আকারের হয়। তাদের ভর সূর্যের ১০০ থেকে ১০০০ গুণ হতে পারে এবং তারা মহাবিশ্বের নির্দিষ্ট স্থানে দেখা যায়।
ব্ল্যাক হোলের কার্যক্রম:
ব্ল্যাক হোলের কার্যক্রম বা তার প্রভাব মহাকর্ষীয়। ব্ল্যাক হোলগুলির চারপাশে অন্যান্য পৃথিবী, গ্যালাক্সি এবং তাদের ভেতরের সব বস্তু চূড়ান্তভাবে আকৃষ্ট হয়ে যায়। ব্ল্যাক হোল থেকে কিছু বের হওয়ার কোনো পথ নেই, শুধু তাদের ভেতরে চলে যাওয়া সম্ভব। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোলের চারপাশে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গতি বিশ্লেষণ করে থাকেন।
আরও পড়ুন:
❒ চাঁদ দিনে দেখা যায় কেন?
❒ সূর্যাস্তের সময় আকাশ লালচে হয় কেন?
❒ কেন আমরা হাই তুলি?
❒ কেন আমরা হাঁচি দিই?
❒ বয়স বাড়লে কেন চুল পেকে যায়?
❒ স্বপ্ন দেখি কেন? স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?
ব্ল্যাক হোলের ভবিষ্যৎ:
ব্ল্যাক হোল ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তার বিশ্লেষণ নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব আছে। তবে সবচেয়ে পরিচিত তত্ত্ব হলো, হকিং রেডিয়েশন (Hawking Radiation), যা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং দ্বারা আবিষ্কৃত। এই তত্ত্বের মতে, ব্ল্যাক হোলের চারপাশে একটি রেডিয়েশন রয়েছে যা ব্ল্যাক হোলের ভর কমিয়ে দেয়। অবশেষে, এই রেডিয়েশন ফলে ব্ল্যাক হোল ভেঙে পড়তে পারে বা “শূন্যে” পরিণত হতে পারে।
ব্ল্যাক হোল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং রহস্যময় মহাকর্ষীয় বস্তু, যার কার্যক্রম এবং গঠন সম্পর্কে অনেক কিছু জানার প্রয়োজন আছে। তবে, এর বিশালতা, অদৃশ্যতা এবং রহস্য মুগ্ধকারী। আগামীদিনে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কিত আরও গভীর গবেষণার মাধ্যমে তার প্রকৃতি সম্পর্কে আরও নতুন তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। মহাবিশ্বের এই গভীর রহস্য সম্পর্কে জানা আমাদের বিজ্ঞানের সীমা আরো বিস্তৃত করতে সহায়তা করবে।
❑ মাথায় কত প্রশ্ন আসে থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুন: মহাবিশ্ব কি নিরন্তর প্রসারিত হচ্ছে?

