‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে …
জন্ম ১৩০৬, মৃত্যু ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ। অঙ্কের হিসাবে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকাল ৭৭ বছরের। কিন্তু সৃষ্টিশীল ছিলেন মাত্র ২৩ বছর। এই ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে তাঁর বিপুল সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর ছড়ানো বিদ্রোহী চেতনা কাঁপিয়ে দেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত। খ্যাতি পেয়েছেন বিদ্রোহী কবির।
অভিষিক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায়। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন-শোষণ থেকে উপমহাদেশের মুক্তির আন্দোলন এবং একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের কবিতা ও গান ছিল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। সংকট ও সম্ভাবনায় নজরুলের সৃষ্টিকর্ম বাঙালির জীবনে জুগিয়ে চলেছে নিরন্তর প্রেরণা।
বিশ শতকে উপমহাদেশ কাঁপানো বাঙালির প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। কবি নজরুল দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র, ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে বঙ্গাব্দ অনুযায়ী কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে।
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’ গানের বাণীর এই আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশ ভোলেনি। কবির আকাঙ্ক্ষাই পূরণ করা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করে।
অসাম্প্রদায়িক নজরুল বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি। সমাজের কূপমণ্ডূকতার অচলায়তন ভাঙারও কবি। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ধূমায়িত সমাজে বসেই তিনি একই সঙ্গে লিখেছিলেন ইসলামী ঐতিহ্য নিয়ে হামদ, নাত, গজল আর হিন্দু ধর্ম ও পুরাণের ঐতিহ্যে শ্যামাসঙ্গীত।
সবার ওপরে মনুষ্যত্বের স্থান চিহ্নিত করে দেশকে মহিমান্বিত করেছেন গভীর দেশপ্রেমে তরুণ সমাজকে উজ্জীবিত করে। লিখেছেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে শিকল ভাঙার গান। ধূমকেতুর অগি্নজ্বালায় দগ্ধ হৃদয়ে জাতিকে শুনিয়েছেন ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙার গান’।
বিদ্রোহী’ রচনা করে বাংলা কাব্যে সৃষ্টি করেছেন তোলপাড়। সেই যুগসন্ধিক্ষণে তিনি মানবতার মুক্তির জন্য যে অবিস্মরণীয় প্রেরণাসঞ্চারী দ্রোহের বাণীতে উচ্চকিত করে তুলেছেন অবিভক্ত বাংলার কোটি কোটি মানুষের চিত্ত, সে বাণীর শাশ্বত দর্শন চিরপ্রাসঙ্গিক।
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার আগুন ঝরানো কবিতা আর শিকল ছেঁড়ার গান। ‘বিদ্রোহী’ ‘অগ্নিবাণী’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ফণীমনসা’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘প্রলয় শিখা’র মতো কবিতার ঝঙ্কারে শুধু শোষক-শাসকের ভিত্তিমূলই কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাংলাও। কারণ এমন কবিতা প্রথম শুনল বাঙালি।
আরও পড়ুনঃ পবিত্র আশুরার শিক্ষা ও তাৎপর্য
প্রবল রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে তিনি রচনা করলেন একই সঙ্গে গণসাহিত্য আবার চিরকালের সাহিত্যও। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্বাগত জানালেন এই নতুন কবিকণ্ঠকে। ‘বসন্ত’ নাটকটি উৎসর্গ করলেন কারাবন্দি নজরুলকে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এমন আশ্চর্য এক নতুন সুর আর নতুন ছন্দের দোলা, হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য আর পুরাণের এমন অপূর্ব প্রয়োগ, প্রেম আর বিদ্রোহের এমন আশ্চর্য সমন্বয় এর তুলনা অতীতে ছিল না, পরেও দেখা যায়নি।
‘বল বীর_/বল উন্নত মম শির!/শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ এই ‘আমি’ সীমাবদ্ধ নয় ব্যক্তি ‘আমি’তে। এই ‘আমি’ ‘বল বীর’ সম্বোধনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব সমগ্র মানবজাতির হয়ে গেছে। এই একটি মাত্র কবিতার মধ্যে নিহিত রয়েছে সমগ্র নজরুলের জীবনদর্শন আর অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ।
কবিতার শেষে তিনি যে বলেন, ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হবো শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না_ …’ সেই অত্যাচারীও পৃথিবীতে আছে, শোষিত-বঞ্চিতও আছে। সেই ধর্মের নামে ভণ্ডামি করা ‘মোল্লা-পুরুত’ লোভীরা যেমন আছে, তেমনি হিংস্র সাম্প্রদায়িকতাও আছে। আর সে জন্যই এখনও প্রেরণার দীপ্ত শিখা অমর কবি নজরুল।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার পরতে পরতে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য-ঝঙ্কারের পাশাপাশি ‘কুমারী মেয়ের কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্’ ধ্বনিও গুঞ্জরিত। ফলে প্রেমে-দ্রোহে সমান্তরাল নজরুল সারাজীবন অসংখ্য দ্রোহের কবিতা আর প্রেমের কবিতা ও গানে মুখর ছিলেন ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে চিরতরে স্তব্ধবাক হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত।
দোলনচাঁপা, সিন্ধু হিন্দোল, চক্রবাক, পুবের হাওয়ার মতো হৃদয় তোলপাড় করা প্রেমের কবিতার কবিকে শুধু ‘বিদ্রোহী’ বললে খণ্ডিত করা হয়। বাংলা গানে নতুন নতুন সুর আর রাগ-রাগিণীর এমন বিশাল সমুদ্র তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, যা চিরঋণী করে রেখেছে বাংলা গানের কোটি কোটি শ্রোতাকে।
‘যুগবাণী’, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, ‘রুদ্রমঙ্গল’ ‘দুর্দিনের যাত্রী’র প্রবন্ধগুলোতে বিশ শতকের প্রথম দিকের বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির যে উজ্জ্বল চিত্র তিনি উৎকীর্ণ করে গেছেন তাও তার অমরতারই অভিযাত্রী। ১৯২৬-এ কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গায় আঁতকে উঠে লিখলেন অমর কবিতা ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’।
লিখলেন অবিস্মরণীয় প্রবন্ধ ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’। হিন্দু-মুসলিম নয়, মানুষ ছিল তার কাছে বড় পরিচয়। তাই মানবতার লাঞ্ছনায় হয়েছেন ক্ষুব্ধ। অভিমান আর ক্ষোভ নজরুল সাহিত্যের সর্বত্র দেদীপ্যমান। ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,/কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।/_নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।_’ সেই ধূপের মতোই নিভৃতে জ্বলেছেন ১৯৪২ থেকে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র ১৩৮৩) পর্যন্ত নির্বাক অবশিষ্ট জীবন।
নজরুল তার একটি গানে বলেছিলেন ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে …।’
সত্যি তাকে ভোলা যাবে না। কালজয়ী সাহিত্য ও সঙ্গীতের এই অনন্য স্রষ্টা এই প্রেমময় পৃথিবীতে, বৈষম্যপীড়িত পৃথিবীতে চিরস্মরণীয় থাকবেন মানবমুক্তির বাণীবাহক হিসেবে। চির অমর হয়ে থাকবেন প্রেমের শাশ্বত বাণীর স্রষ্টা হিসেবেও।
নজরুল ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ সকালে নজরুল সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
❑ সম্পাদকীয় থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ বাঘা শাহী মসজিদ, রাজশাহী