ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কারক বাংলাদেশী আজিজুল হক । এই যে আঙুলের ছাপ দিয়েই খুলে যাচ্ছে মোবাইলের লক, গেটের তালা, অফিসের উপস্থিতি, ফিঙারপ্রিন্ট নিয়েই যাচাই করা যাচ্ছে কে অপরাধী, আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট—এক অনন্য জিনিস। অপরাধবিজ্ঞান বলে, পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের আঙুলের ছাপই আলাদা, কারও সঙ্গে কারোর আঙুলের ছাপের হুবহু মিল নেই।
অপরাধী শনাক্তে পুলিশ-গোয়েন্দাদের বড় ভরসা আঙুলের ছাপ। শুধু কি অপরাধী শনাক্ত? আজকের দিনে আঙুলের ছাপ হয়ে উঠেছে আমাদের পরিচয় শনাক্তের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে এক ধাক্কায় বিজ্ঞান এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটা পথ। আর এই আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণ পদ্ধতির আবিষ্কারক ছিলেন এই বঙ্গেরই বাসিন্দা।
তার নাম কাজী আজিজুল হক। এই বাঙালির আবিষ্কৃত পদ্ধতি আজ গোটা বিশ্বে স্বীকৃত, সমাদৃত। নিখুঁতভাবে অপরাধী শনাক্ত করার পথে বহু বছর পিছিয়ে থাকতে হতো আজিজুল হকের এই আবিষ্কার না হলে। অথচ মহা-তাৎপর্যপূর্ণ এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব তিনি পাননি।
ফিঙারপ্রিন্ট নিয়ে অনেকেই আগে কাজ করেছেন কিন্তু এর প্র্যাকটিক্যাল ইউজ কি, কিভাবে যাচাই করা যায়, কিভাবে ফিঙারপ্রিন্ট দিয়ে আলাদা করা যায় মানুষকে সেটা প্রথম আবিষ্কার করেন আমাদের দেশের কাজী আজিজুল হক।
আঙুলের ছাপ শনাক্ত করার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক বঞ্চনার ইতিহাস। দখলদার ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা ভারতীয়দের বহু কৃতিত্ব ও সম্পদ নিজেদের পকেটে পুরেছে। আরও অনেক কিছুর মতোই আজিজুল হকের আবিষ্কারের কৃতিত্বও চুরি করেছিলেন স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি নামের এক ব্রিটিশ। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ইতিহাস।
খান বাহাদুর কাজী আজিজুল হকের জন্ম ১৮৭২ সালে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) খুলনা জেলার ফুলতলার পয়গ্রাম কসবায়। শৈশবেই আজিজুল বাবা-মাকে হারান এক নৌকা দুর্ঘটনায়। বাবাকে হারিয়ে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়ে তার পরিবার। পরিবারের দায়িত্ব বর্তায় আজিজুলের বড় ভাইয়ের কাঁধে।

আজিজুল ছিলেন দারুণ মেধাবী। ছোটবেলা থেকেই কঠিন সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন অনায়াসে। তিনি আবার ভোজনরসিকও ছিলেন। জীবনে দুটো জিনিস সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন আজিজুল—গণিত আর খাবার।
কিন্তু অভাবের সংসারে আজিজুলের রসনার চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো না। বেশি খাওয়ার জন্য বড় ভাই প্রায়ই গালাগাল দিতেন আজিজুলকে। বাড়ি থেকে রাগ করে ১৮৮৪ সালে ১২ বছরের বালক আজিজুল পা রাখে মহানগরী কলকাতায়। এখান থেকেই শুরু আসল কাহিনি।
বহু পথ পাড়ি দিয়ে পা রাখেন কলকাতা মহানগরীতে। ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত আজিজুল হক নগরীর কোন এক বাড়ির সামনে এসে ঘুমিয়ে পড়েন।
সে ঘুমন্ত কিশোরটিকে বাড়ির অভিভাবকের ভালো লেগে যায়। ফলে তিনি তার লালন-পালন, লেখাপড়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। গণিতে আজিজুল হকের মাথা খুবই ভালো ছিলো।
হাইপেরিয়ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত ফিঙ্গার প্রিন্টস বইয়ের লেখক ও গবেষক কলিন বিভানের মতে- আজিজুল হক যখন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, তখন তাকে ফিঙ্গার প্রিন্ট তথা আঙুলের ছাপ সংক্রান্ত একটি প্রকল্পে কাজ করার জন্য মনোনীত করা হয়। স্বয়ং কলেজের অধ্যক্ষই তাকে মনোনীত করেন। ব্রিটিশরাজের অধীনস্থ বাংলার পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল তখন স্যার অ্যাডওয়ার্ড হেনরি। তার নেতৃত্বেই এই প্রকল্পের কাজ চলছিলো।
গণিত ও পরিসংখ্যানে ভালো, এমন কাউকে তিনি খুঁজছিলেন এ কাজে। এ ক্ষেত্রের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে কলেজের অধ্যক্ষ আজিজুল হককেই এ কাজের জন্য বেছে নেন।
অধ্যক্ষের সুপারিশে পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে ১৮৯২ সালে চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে হেনরি তাঁকে তাঁর প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ করে দেন।
অখণ্ড বাংলায় তখন অ্যানথ্রোপমেট্রি (মানবদেহের আকৃতি) পদ্ধতিতে অপরাধী শনাক্ত করার কাজ চলত। অ্যাডওয়ার্ড হেনরি এই পদ্ধতিতে বেশ ত্রুটি খুঁজে পেলেন। দেখলেন, একজন লোকের দেহের মাপ বিভিন্ন হাতে এক ধরনের থাকে না।
কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কাজ শুরু হয়ে গেলো। ১৮৯৩ সালের ৩ জানুয়ারি তাই তিনি এক পরওয়ানা বলে অপরাধের সঙ্গে জড়িত লোকজনের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের টিপ নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এর তিন বছর পর তিনি ধরা পড়া প্রত্যেক অপরাধীর দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আঙুলের ছাপ নেওয়া এসব কাগজপত্র ফাইলভুক্ত করে রাখা নিয়ে। তখন এই কাজে এগিয়ে এলেন এবং সফল হলেন গণিতের ছাত্র এবং সদ্য সাব-ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ পাওয়া আজিজুল হক।
কাজ শুরু হলো কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। আজিজুল তৈরি করলেন সিস্টেমের গাণিতিক ভিত্তি। আর হেমচন্দ্র বানালেন আঙুলের ছাপের টেলিগ্রাফিক কোড সিস্টেম। নিজের তৈরি বিশেষ এক গাণিতিক ফর্মুলার ওপর ভিত্তি করে আজিজুল ৩২টি সারি বানান। তারপর ওই ৩২ সারিতে বানান ১ হাজার ২৪টি খোপ। এসব খোপে তিনি গড়ে তুললেন ৭ হাজার আঙুলের ছাপের বিশাল সংগ্রহ। এতে অনেকটাই সহজ হয়ে যায় লাখ লাখ আঙুলের ছাপের শ্রেণিবিন্যাস করার কাজ।
আজিজুল-হেমচন্দ্র-হেনরির গবেষণা অপরাধবিজ্ঞানে বিপ্লব আনে। বর্তমান বায়োমেট্রিক সিস্টেম তৈরিতেও বড় ভূমিকা রেখেছে ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন’। আঙুলের ছাপের সাহায্যে অপরাধী শনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কারের মূল কাজটি করেছেন আজিজুল হক।
কিন্তু কাজের পুরো কৃতিত্ব নিজের পকেটে পুরে নিলেন স্যার হেনরি। এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয় তারই নামে—’হেনরি সিস্টেম’। নানা যাচাই-বাছাইয়ের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আঙুলের ছাপের সাহায্য অপরাধী শনাক্ত করার প্রচলন শুরু হয়। ১৯০০ সালের মধ্যে অ্যানথ্রোপমেট্রিকের জায়গা নিয়ে নেয় এই পদ্ধতি।
অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অনবদ্য চেষ্টার ফলে তিনি যে পদ্ধতি উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করলেন, তা-ই ‘হেনরি সিস্টেম’ বা ‘হেনরি পদ্ধতি’ নামে পরিচিতি পেলো। অ্যাডওয়ার্ড হেনরি নিজের নামেই তা চালিয়ে দিলেন। এই হেনরি রহস্যের জট খুলতে লেগে গেছে ১০০ বছর।
অবশ্য সেসময় তার কাজের পুরস্কার হিসেবে আজিজুল হককে দেওয়া হয়েছিল ‘খান বাহাদুর উপাধি’, পাঁচ হাজার টাকা এবং ছোটখাটো একটা জায়গির। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন পুলিশের এসপি। অবিভক্ত ভারতের চম্পারানে (বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের একটি জেলা যা উত্তর চম্পারান নামে পরিচিত) কেটেছে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। সেখানেই তিনি ১৯৩৫ সালে মারা যান।
যদিও কিছুদিন আগে ব্রিটেনের “দ্যা ফিঙারপ্রিন্ট সোসাইটি” চালু করেছে “The Fingerprint society Azizul Huque & Hemchandra Bose prize”।ওদিকে যে সিস্টেমের নাম হতে পারত “হোক-বোস সিস্টেম ” তা আজ-ও “হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম”-ই রয়ে গেছে।আর অজানায় থেকে গেছেন আমাদের আজিজুল হক।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)
আরও পড়ুনঃ রূপসা জমিদার বাড়ি, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর


