বিদ্রোহী ও প্রেমিক কবি নজরুল
কবিতা কবি মনের সহজ-স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি। তাই কবির বিষয়-বৈচিত্রের প্রসারতা অনেক বেশি। পৃথিবীর সামান্য ধূলিকণা থেকে শুরু করে গ্রহ-নক্ষত্র, সবুজ-শৈল সব কিছুই কবি হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার মাধ্যম হতে পারে।
এতদসত্ত্বেও একেকজন কবির একেকটি আলাদা প্রতিভা থাকে, যা তাঁকে আমীন করতে পারে সাফল্যের সুউচ্চ শিখরে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্যের জন্য যেমন অমর হয়ে আছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথঠাকুর বিচিত্র বিষয়ে কবিতা রচনা করলেও মূলতঃ তাঁর আধ্যাত্ম মানি সানমিকতার কাব্য The songs offering কাব্য রচনা করে নোবেল পুরুষ্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে পাঠক সমাজে স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশ্বকবি হিসেবে।
আর আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম খ্যাত হয়ে আছেন তাঁর ব্যতিক্রম-ধর্মী কবিসত্বা বিদ্রোহের জন্য। এর সাথে ছিল তাঁর অফুরন্ত প্রেমাবেগ, যা তাঁকে বিশিষ্টতা দান করেছে। একই সাথে দুই বিপরীতধর্মী কবিসত্ত্বা, বিদ্রোহ ও প্রেম, নজরুলের পূর্বে বা পরে এমন স্বার্থক ও ভাবে আর কারো মধ্যে ফুটে উঠতে দেখা যায় না। নজরুল সুউচ্চ শৈলশিখরের মত।
ঝড় সেখানে আঘাত হানে, সেখ অন্ধকার বিছিয়ে দেয়, কিন্তু সেই উর্ধ্বতায় উঠতে পারলে আমরা প্রাণহরে নিশ্বাস নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে পারিংসা আর কোথাও কারো কাছে সম্ভব নয়। সেই জন্যই নজরুল ইসলাম আমাদের শত বছরের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, শ্রেষ্ঠ অবদান। বহুযুগের বহু কোটি মানুষের দেহ-মন মিলিয়ে নজরুলের সত্তা সৃষ্টি হয়েছিল, তাই নজরুল সত্তা আমাদের কাছে মহামানবের সত্তা।
বাংলাদেশে নজরুল ‘বিদ্রোহী-কবি’ হিসেবেই অধিক খ্যাত, সেটা যেমন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার জন্য, তেমনি পরাধীনতা, সামাজিক রাশীলতা, গোঁড়ামী, সাম্প্রদায়িকতা, দারিদ্র ও অসাম্যের বিরুদ্ধে আপোষহীন লেখনী পরিচালনার জন্যও।
নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী ছিলেন। কিন্তু কেন? যে সত্বাটি আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কিংবা মধুসুদন বা জসিম উদ্দীনের মাঝে দেখি না, সেই বিদ্রোহী সত্বাটি কেন নজরুল মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল? এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদের একটু তাকাতে হয় নজরুলের সময়কার সমাজ এবং স্বদেশ ও বিদেশের পরিস্থিতির দিকে।
যে সময় নজরুলের জন্ম, তখন মুসলমান-দের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। কি স্বদেশ কি বিদেশ সর্বত্র একই অবস্থা। দেশের সর্বত্রই চলছিল অনাচার-অত্যাচারের প্রবাহ। ধনী কর্তৃক নির্ধনকে শোষণ সামাজিক জীবনে নির্বিবাদে রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। আশরাফ-আতরাফের ভেদ গৃহিত হয়েছিল ধর্মের বিধান বলে। অন্য-দিকে দেশের বাইরে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিরাট ভূ-খন্ডের মালিক এবং জাজিরাতুল আরব-এর সংরক্ষণকারী তুর্কীর সুলতান বলকান যুদ্ধের পর এ হৃত-সর্বম্ব। প্রশ্ন পরবর্তীতে প্রথম মহাসমরের পরে একেবারে নিঃস্ব।
এমনই মুহূর্তে ধুমকেতুর মশাল হাতে আবির্ভাব নজরুলের। তিনিই সর্বপ্রথম বুঝলেন, এই মৃতপ্রায় জাতিকে জাগাতে হলে তাদের যৌবনমন্ত্রে দিক্ষীত করতে হবে। তাদের মধ্যে জাগাতে হবে মানবতার অহংবোধ। তাই চির যৌবনা বিদ্রোহী মূর্তি ধাধন ধারণ করে বললেন-
বল বীর
বল উন্নত মম শীর!
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।
[বিদ্রোহী]
প্রেমিক সত্বা নজরুলের আরেক অমামান্য সত্বা। তাঁর এই প্রেমে যেমন ছিল পরিপূর্ণ রোমান্টিকতা, তেমনি ছিল বিদ্রোহও। প্রেমের কবিতায় নজরুল রবীন্দ্রনাথের মত আদর্শে অমানবিক রহস্যময়ী, মানস সুন্দবী বা জীবনদেবতার উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ যাত্রী নন; কিন্তু কোন আদর্শ প্রিয়াকে, অনামিকাকে কামনা-বাসনার সীমিত গম্ভীর মধ্যে পেতে ক্রন্দনরত, চিরবিরহী।
অসীমা! এলে না তুমি সীমারেখা-পারে স্বপনে পাইযা তোমা’ স্বপনে হারাই বারেবারে।
রবীন্দ্রনাথ যেমন স্পর্শ করতে পারেন না রহস্যময়ী অপরিচিতার শাড়ীর আঁচল, তেমনি তাই কবি বলতে পারেন পারেন না নজরুলও। 1
‘বৃথা আমি খুঁজে মরি জন্মে জন্মে করিনু রোদন।’
এই না পারার জন্য কবি দায়ী করেছেন অধরা নারীকেই। তাই নারীর উপর কবির তিক্ততার মার্ক বিদ্রোহী উচ্চারণ-
নারী নহে হতে চায় শুধু একা কারো
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পুজা পায় এরা চায় তত আরো
ইহাদের অতি লোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়
যাচ্ছে বহুজন।
সংস্কৃতিপরায়ন মনের সূক্ষ্ম উপলব্ধি দিয়ে নজরুলের কবিতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য উপভোগ করার দরকার হয় না, যাতে সকলের ভাল লাগে, বক্তব্য বিষয়কে অস্পষ্ট না করে সোজাসুজি মানুষের মন ছুঁতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি রেখেই তিনি তাঁর সাহিত্যকে নিতান্ত সহজবোধ্য করেই রচনা করেছেন। সেইজন্য সকল শ্রেণীর সকল স্তরের মানুষের মধ্যে নজরুল এত জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন:
❒ পহেলা বৈশাখ: ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও জাতিগত ঐক্যের প্রতীক
❒ স্বাধীনতার চেতনা এবং জাতির অগ্রযাত্রা
❒ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের আত্মপরিচয়ের দিন
❒ বিজয়ের ৫৪ বছর পরে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা
❒ সুস্বাগতম মাহে রমজান
❒ একযুগ পূর্তিতে আইসিটি ওয়ার্ল্ড নিউজ
আজ ১২ ভাদ্র ১৪৩২, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। দ্রোহ, সাম্য, প্রেম ও মানবতার কবি হিসেবে তিনি বিশ্বের অনন্য উদাহরণ। ১৩৮৩ সনের এই দিনে (১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে কবির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা জানাবেন দেশের মানুষ।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। শৈশব থেকেই কঠিন দারিদ্র্য মোকাবিলা করে বড় হয়েছেন তিনি। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র ঢাকার বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) নিভে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের এ অনন্য প্রতিভার জীবনপ্রদীপ।
❑ সম্পাদকীয় থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুন: ঈদুল আযহার শিক্ষা-ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক মানবতা

