আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: হুমায়ূন স্যারের শুভ জন্মদিন । শুভ জন্মদিন। আজ হুমায়ূন স্যারের ৭৫তম জন্মদিন। জন্মদিন এবার একভিন্ন পরিবেশে উদযাপিত হচ্ছে। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি এখন ভিন্ন জগতের অধিবাসী। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আশা করারও আজ আর কোনো অবকাশ নেই। আমাদের কাছে অন্তত এবারকার উদযাপন বিষাদের আবরণ-মোড়া। এমুহূর্তে তাকে ভাবতে গিয়ে হারানোর ব্যথাই বড় হয়ে বুকে বাজছে!
জানি এবং বিশ্বাসও করি, হুমায়ূন আহমেদের এই যাওয়া কোনো ভাবেই হারিয়ে যাওয়া নয়। তিনি আছেন এবং থাকবেন, প্রবল ভাবেই থাকবেন আমাদের হৃদয়-মনজুড়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ধরে। যে হুমায়ূন এতকাল ছিলেন বাইরে, আজ তিনি আমাদের চেতনায় মিশে একাকার। এস্থান অনড়। আর এই খানে এসে মৃত্যু পরাজিত। সৃষ্টির সুবাদে অমরত্ব পাওয়া হুমায়ূন চিরঞ্জীব।
হুমায়ূন আহমেদর বিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালি জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় লেখক হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার। বলা হয়, বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন।
ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান; ডাক নাম কাজল। তাঁর পিতা নিজের নাম ফয়জুর রহমানের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান।পরবর্তীতে তিনি নিজেই নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, তাঁর পিতা ছেলে-মেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে পছন্দ করতেন। ১৯৬২-৬৪ সালে চট্টগ্রামে থাকা কালে হুমায়ুন আহমেদের নাম ছিল বাচ্চু।
তাঁর বাবা চাকুরী সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছেন বিধায় হুমায়ূন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষাদেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সব গ্রুপে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি হসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪নং কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থডাকোটাস্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এক সময় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন তিনি৷ শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন এই অধ্যাপক৷ হুমায়ূন আহমেদ ২০১২ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে জাতিসংঘে বাংলাদেশ দূতাবাসে সিনিয়র স্পেশাল অ্যাডভাইজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ছাত্রজীবনে একটি নাতি দীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবনের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাসটির নাম নন্দিতনরকে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাঙলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। শঙ্খনীল কারাগার তাঁর ২য় গ্রন্থ।এ পর্যন্ত (২০১১) তিনি দুইশতাধিক গল্প গ্রন্থ ও উপন্যাস প্রকাশনা করেছেন। তাঁর রচনার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো ‘গল্প-সমৃদ্ধি’।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথমা স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং দুই ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। অন্য আরেকটি ছেলে অকালে মারা যায়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে শীলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসান কল্পে ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্ম গ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
জীবনের শেষ ভাগে ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডীর ৩/এরোডে নির্মিত দখিন হাওয়া এ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্লাটে তিনি বসবাস করতেন। খুব ভোর বেলা ওঠা অভ্যাস ছিল তাঁর, ভোর থেকে সকাল১০-১১ অবধি লিখতেন তিনি। মাটিতে বসে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কখনো অবসর পেলে ছবি আঁকতেন। জীবনের শেষ একযুগ ঢাকার অদূরে গাজীপুরে রগ্রামাঞ্চলে ৯০বিঘা জমির ওপরস্থাপিত বাগান বাড়ী নুহাশ পল্লীতে থাকতে ভালোবাসতেন তিনি। তিনি বিবর বাসী মানুষ; তবে মজলিশী ছিলেন। গল্প বলতে আর রসিকতা করতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি ভণিতাবিহীন ছিলেন। নিরবে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করা তার শখ। তবে সাহিত্য পরিমণ্ডলের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি বা দলাদলিতে তিনি কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেননি। তিনি স্বল্পবাক, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্তরাল জীবন-যাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তবে খুব একটা নিসঙ্গতা পছন্দ করতেন না। কোথাও গেলে আত্মীয়-স্বজনবন্ধু-বান্ধব নিয়ে যেতে পছন্দ করতেন। বাংলাদেশে তাঁর প্রভাব তীব্র ও গভীর; এ জন্যে জাতীয় বিষয়েও সঙ্কটে প্রায়ই তাঁর বক্তব্য সংবাদ মাধ্যম সমূহগুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে থাকত।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাকে আটক করে এবং নির্যাতনের পর হত্যার জন্য গুলি চালায়। তিনি অলৌকিক ভাবে বেঁচে যান। ২০১১-এর সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর দেহে আন্ত্রীয় ক্যান্সার ধরা পড়ে। তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়েনা-পড়ায় সহজে তাঁর চিকিৎসা প্রাথমিক ভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউইয়র্কের বেলেভ্যু হসপিটালে বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদ পুরুষ ইন্তেকাল করেন। এর পুর্বে ১২দফায় তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তিনি দ্রুত অবনতির দিকে যান। তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়।
আরও পড়ুনঃ বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের কালজয়ী এক পথিকৃতের নাম জহির রায়হান