যেভাবে বুঝবেন আপনি অহংকারী । অহংকারকে আরবিতে বলা হয় উম্মুল আমরাজ। এর অর্থ- সকল পাপের জননী। যার অন্তরে অহংকার আছে সে জান্নাতে যেতে পারবে না বলে একাধিক সহিহ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত। সহিহ মুসলিমে ইবনু মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে আছে—‘যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ মুসলিম: ১৬৭) মুমিন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হলো- সে অহংকারী হবে না। তাই তাকে নিজেকে পরীক্ষা করে নিতে হবে এবং অন্তরে অহংকার বাসা বাধলে তা ধ্বংস করে দিতে হবে।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পাপই হচ্ছে অহংকার। আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর তাঁকে সেজদা করার জন্য আল্লাহ তাআলা যখন সবাইকে আদেশ করেন, তখন ফেরেশতারা সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন। কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা ইবলিসের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অহংকার প্রকাশ পেয়ে গেল। সে আগুনের তৈরি বলে আদম (আ.)-কে সেজদা করতে অস্বীকার করল। সে আল্লাহকে যুক্তি দেখিয়েছিল, ‘আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আদমকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে’ (সুরা আরাফ: ১২)। অতএব ‘আমি কি তাকে সেজদা করব, যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন?’ (সুরা ইসরা: ৬১)
ফলে তার অধঃপতন হলো। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘সে অস্বীকৃতি জানাল এবং অহংকার করল। আর সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা বাকারা: ৩৪)
অহংকারীদের অন্তর মোহরাবৃত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার নিদর্শনাবলী থেকে বিমুখ করে রাখব’ (সুরা আরাফ: ১৪৬)। ফলে হক-বাতিলের পার্থক্য সে করতে পারে না। ইরশাদ হচ্ছে, ‘এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী দাপুটে ব্যক্তির অন্তরে মোহর মেরে দেন।’ (সুরা গাফির: ৩৫)
আরও পড়ুনঃ যেসব আমলে সদকা আদায়ের সওয়াব মেলে
অনেকে অন্তরে অহংকার বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নিজেকে অহংকারমুক্ত মনে করে থাকেন। নিজের মধ্যে অহংকার আছে কিনা তা যাচাই করবেন যেভাবে—
যেভাবে বুঝবেন আপনি অহংকারী
১. নিজেকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকে তুচ্ছ ভাবার বদভ্যাস থাকলে বুঝে নেবেন আপনি নিশ্চিত অহংকারী। ঠিক এই দোষেই অভিশপ্ত হয়েছিল ইবলিস। (সুরা আরাফ: ১২; ইসরা: ৬১)। তার অহংকারের প্রতিউত্তর আল্লাহ তাআলা এভাবে দিয়েছেন— ‘বের হয়ে যাও এখান থেকে। কেননা তুমি অভিশপ্ত।’ (সুরা সোয়াদ: ৭৬)
২. সত্যকে অস্বীকার করা। নমরুদ, আবু জাহেল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা, আরও অসংখ্য দাম্ভিক সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। রাসুল (স.) বলেছেন—‘ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। তখন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তাদের পোশাক সুন্দর হোক, জুতা জোড়া সুন্দর হোক। জবাবে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার হলো সত্যকে দম্ভের সঙ্গে পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।’ (মুসলিম: ৯১)
৩. হাঁটাচলায় বড়ত্ব প্রকাশ করা। বর্তমান সমাজে দেখা যায়—পেছনে দলবল নিয়ে কিছু মানুষ এমনভাবে চলেন যেন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ। এধরণের সামান্য লক্ষণ দেখেই ওমর (রা.) সাবধান করেছিলেন উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে। উবাই (রা.)-এর পেছনে একদল লোককে চলতে দেখে খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তাঁকে চাবুক দিয়ে আঘাত করলেন। এতে চমকে উঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন—ব্যাপার কী হে আমিরুল মুমিনিন! জবাবে খলিফা বলেন, ‘এটা অনুসরণকারীর জন্যে লাঞ্ছনাকর এবং অনুসৃত ব্যক্তিকে ফেতনায় (অহংকারে) নিক্ষেপকারী।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৩১২৪৪)
৪. অর্থ-সম্পদ ও সৌন্দর্যের কারণে অন্যের প্রতি অন্তরে তুচ্ছভাব উদ্রেক হওয়া। একদিন সাহাবি আবু জর গিফারি (রা.) হাবশি বেলাল (রা.)-কে তাঁর কালো মায়ের দিকে ইঙ্গিত করে তাচ্ছিল্য করলে রাসুল (স.) তাঁকে ধমক দিয়ে বলেন—‘হে আবু জর! তুমি তাকে তার মায়ের নামে তাচ্ছিল্য করলে? তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত রয়েছে।’ (বুখারি: ৩০)
৫. দরিদ্র ও অধীনস্থদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা অহংকারের একটি বড় আলামত। প্রভাব খাটিয়ে যারা এদের হক নষ্ট করে তাদের শাস্তি অত্যন্ত লাঞ্ছনাকর। এধরণের ব্যক্তিতে কেয়ামতের দিন পিঁপড়াসদৃশ করে লাঞ্ছনাকর অবস্থায় হাঁটানো হবে। (তিরমিজি: ২৪৯২)
৬. ভুল স্বীকার না করা এবং নিজের ভুল অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। আব্দুর রহমান বিন মাহদি (রহ.) বলেন, আমরা এক জানাজায় ছিলাম। সেখানে ওবায়দুল্লাহ বিন হাসান উপস্থিত ছিলেন, যিনি তখন রাজধানী বাগদাদের বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। আমি তাঁকে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি ভুল জবাব দেন। তখন আমি বললাম, ‘আল্লাহ আপনাকে সংশোধন হওয়ার তাওফিক দিন! এ মাসআলার সঠিক জবাব হলো এই, এই। তখন তিনি কিছুক্ষণ দৃষ্টি অবনত রাখেন। অতঃপর মাথা উঁচু করে দুই বার বলেন, ‘এখন আমি প্রত্যাবর্তন করলাম এবং আমি লজ্জিত।’ অতঃপর বলেন, ‘ভুল স্বীকার করে হকের লেজ হওয়া বাতিলের মাথা হওয়ার চেয়ে আমার কাছে অধিক প্রিয়। ’ (তারিখু বাগদাদ: ১০/৩০৮)
৭. নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবা। মানুষ ও সকল প্রাণী আল্লাহর দয়ায় চলে। কাউকেই আল্লাহ স্বয়ংসম্পূর্ণ করেননি। পবিত্র কোরআনের হুঁশিয়ারি—‘মানুষ অবশ্যই সীমা লঙ্ঘন করে। কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।’ (সূরা আলাক: ৬-৭)
অহংকার দূর করার উপায়
১. নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা। মানুষের সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্বের জন্য। এই চিন্তার জাগরণ ও লালন অহংকার দমনে সহায়ক। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু আমার ইবাদত করার জন্য।’ (সুরা জারিয়াত: ৫৬)
২. যেসব বিষয় মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে, সেগুলোকে তুচ্ছ মনে করা। যেমন—বংশের অহংকার, ধন-সম্পদের অহংকার, পদমর্যাদার অহংকার, বিশেষ কোনো প্রাপ্তির অহংকার। এগুলো আল্লাহর দান। তিনি যেকোনো সময় এগুলো ফিরিয়ে নিতে পারেন। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘(যদি তুমি সুখী হতে চাও), তাহলে যে ব্যক্তি তোমার চেয়ে নিচু, তার দিকে তাকাও। কখনো ওপরের দিকে তাকিয়ো না। তাহলে তোমাকে দেওয়া আল্লাহর নিয়ামত তুমি হীন মনে করবে না।’ (বুখারি: ৬৪৯০, মুসলিম: ২৯৬৩)
৩. আল্লাহ সব কিছু দেখছেন ও শুনছেন—এ কথা সবসময় মনে রাখা। ইরশাদ হয়েছে, ‘মনে রেখো, দুজন গ্রহণকারী ফেরেশতা মানুষের ডানে ও বাঁয়ে বসে সর্বদা তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে। মানুষ মুখে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার কাছেই আছে।’ (সুরা ক্বফ: ১৭-১৮)
৪. গরিব, এতিম ও অসহায়দের সঙ্গে থাকা। তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা আমাকে দুর্বলদের মধ্যে তালাশ করো। অর্থাৎ তাদের প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে আমার সন্তুষ্টি অন্বেষণ করো।’ (আবু দাউদ: ২৫৯৪)
৫. নিজের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ কি দেখে না যে আমি তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রাণু থেকে? অথচ পরে সে হয়ে পড়েছে প্রকাশ্যে বিতর্ককারী।’ (সুরা ইয়াসিন: ৭৭)
৬. পরকাল নিয়ে চিন্তা করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘সেদিন উপস্থিত করা হবে প্রত্যেকের আমলনামা। অতঃপর তাতে যা আছে, তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতঙ্কগ্রস্ত। তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটা কেমন আমলনামা যে ছোট-বড় কিছুই বাদ পড়েনি, সব কিছুই লিখে রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। আসলে তোমার প্রতিপালক কারো ওপর জুলুম করেন না।’ (সুরা কাহাফ: ৪৯)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাই নিজেদের অন্তরের সুপ্ত অহংকার ধ্বংস করার তাওফিক দান করুন। অহংকারমুক্ত জীবন যাপনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
আরও পড়ুনঃ তুরস্কের মসজিদে কোরআন শিখেছে ২৪ লাখ শিক্ষার্থী