আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: মাত্র ৮ বিডিআর সদস্যের কাছে পরাজিত হয়েছিল ভারতীয় বাহিনী । মাত্র ৮ জন বিডিআর সদস্যের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে।
কিন্তু তাদের এই বীরত্বের পরেও তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালককে তার পদ থেকে সরিয়ে দেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত লাগোয়া বড়াইবাড়ি গ্রামটিতে কি হয়েছিলো ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল?
যুদ্ধ বড়াইবাড়িতে হলেও ঘটনার শুরু সিলেটের পাদুয়া থেকে। তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান বিবিসিতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সিলেটের পাদুয়াতে বাংলাদেশ সীমান্তের ভিতরে দীর্ঘদিন অবৈধভাবে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প করে রেখেছিলো বিএসএফ।
তবে এ নিয়ে দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে কোন উত্তেজনা ছিলো না। ২০০১ সালে বিএসএফ পাশের আরেকটি ক্যাম্পের সাথে একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ শুরু করে বাংলাদেশ সীমান্তের উপর দিয়েই। এমন অবস্থায় বিডিআরও একই জায়গায় একটি অপারেশনাল ক্যাম্প স্থাপন করে।
আরও পড়ুনঃ জনরোষে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা ও রেহানা
বিডিআর সড়ক নির্মাণ নিয়ে আপত্তি জানালেও বিএসএফ তাতে কর্ণপাত করেনি, উলটো বিডিআরের অপারেশনাল ক্যাম্পে ৬ রাউন্ড গুলি করে। জবাবে বিএসএফের ক্যাম্পটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে বিডিআর এবং ৭০ জন বিএসএফ সদস্য নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পন করে ভারতে ফিরে যায়।
প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে যে, লজ্জাজনক এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পরিকল্পনা শুরু করে বিএসএফ এবং কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্প দখলে নেয়ার প্রস্তুতি নেয়। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভোর রাতে স্থানীয় কিছু কৃষক তাদের জমিতে সেচ দিচ্ছিলেন।
এমন সময় তারা দেখেন ভারী অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে হেঁটে আসছে কয়েক শ’ সেনা। তাদের মধ্যে কয়েকজন হিন্দী ভাষায় বিডিআর ক্যাম্পের অবস্থান জানতে চায় কৃষকদের কাছে। কৃষকদের একজন, সাইফুল ইসলাম বুদ্ধি করে তাদের ভুল ঠিকানা দেয় এবং বিএসএফ সে দিকেই রওনা হয়।
সাইফুল ইসলাম বলেন, বিএসএফকে ভুল ঠিকানায় পাঠিয়ে তিনি ছুটে আসেন বড়াইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্পে। সে সময়ে ক্যাম্পে ছিলেন মাত্র ৮ জন বিডিআর সদস্য।
তারা এই খবর পাওয়ার পর দ্রুত গ্রামবাসীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেন এবং নিজেরা ক্যাম্প ফাঁকা রেখে, গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে পজিশন নেন। কৃষক সাইফুল ইসলাম নিজেও আনসারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন, তিনিও অস্ত্র হাতে নেন বিডিআর সদস্যদের সাথে। এরপর অপেক্ষা…
স্থানীয় বেশ কিছু বাসিন্দা বিবিসিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, বিএসএফ সদস্যরা ভুল ঠিকানা থেকে আবার গ্রামের দিকে ফিরে আসে এবং বিডিআর ক্যাম্পটি খুঁজে পায়। সাথে সাথে তারা ক্যাম্প লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।
আরও পড়ুনঃ যেসব কারণে শেখ হাসিনার পতন
কিছুক্ষণ গুলি ছোড়ার পর তারা ভাবেন, হয়ত বিডিয়ার সদস্যরা ভয়ে ক্যাম্প ফাঁকা রেখে পালিয়ে গেছেন। এমন সময় বিএসএফ সদস্যদের মাঝে রেখে চারদিক থেকে গুলি করা শুরু করেন ৮ জন বিডিআর সদস্য। বিএসএফ মনে করে, তাদের হয়ত চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। তারা দিকবিদিক শূণ্য হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে এবং পিছিয়ে যায়।
প্রথমে গ্রামবাসী পালিয়ে গেলেও ভোর ৫টা থেকে যখন প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়, তাদের মধ্য থেকে আনসারের ট্রেনিং প্রাপ্ত আরও ১২ জন ফিরে এসে বিডিআরের সাথে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ১৮ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকে গোলাগুলি।
দুপুরে কিছুটা বিরতি দিয়ে সন্ধ্যা থেকে আবারও চলতে থাকে গুলি। সদরদপ্তরে খবর পৌঁছালে ময়মনসিংহ ও জামালপুর থেকেও বিডিআর সদস্যরা বড়াইবাড়ি এসে পৌছান। ১৮ এপ্রিল সারাদিন, সারা রাত এবং ১৯ এপ্রিল সারা রাত গোলাগুলি চলে। এক পর্যায়ে পালিয়ে যায় বিএসএফ সদস্যরা।
এই যুদ্ধে ২ জন বিডিআর সদস্য মৃত্যু বরণ করেন আর বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর, ধান খেতে ১৬ জন বিএসএফ সদস্যের মৃত দেহ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা বলেন বিএসএফের অন্তত ১৭০ জন সদস্য নিহত হয়। বাকিদের দেহ তারা ভারতে নিয়ে যেতে পারলেও ফেলে যায় ১৬টি দেহ।
কিন্তু প্রকৃত হতাহতের আনুষ্ঠানিক সংখ্যা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কিছুদিন পর পতাকা বৈঠক করে সেই মৃত দেহগুলো ফেরত দিতে চাইলেও সেগুলো নিতে অস্বীকৃতি জানায় বিএসএফ। কিন্তু পরবর্তীতে সেগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়।
আরও পড়ুনঃ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩৬ দিনে হাসিনা সরকারের পতন
২০০১ সালের ৭ই মে ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই ঘটনার তীব্র ক্ষোভ জানায় ভারত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে আশ্বাস দেন যে এই ঘটনার তদন্ত করা হবে। এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না বলেও জানান।
শুধু তাই না, বিবিসির প্রতিবেদনে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথাও উঠে আসে যে, শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলতে এবং ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট করতে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আর তাই তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমানকে তার পদ থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে বদলি করে দেয়া হয়।
এবং পরবর্তীতে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। ২০১২ সালে বিবিসিতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফজলুর রহমান জানান, তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।
পেছনে কারণ যাই হোক, ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ৮ জন বিডিআর সদস্য ও গ্রামের কিছু লোকের বিচক্ষণতায় ভারতের সাথে হওয়া একমাত্র যুদ্ধে জয় লাভ করে বাংলাদেশ।
জেনারেল রহমান বিবিসিকে বলেন, সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন তিনি এবং আপোষহীনভাবেই তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন আর মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাভিশন
❑ বাংলাদেশ থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ ড. ইউনূস সরকারের প্রতি ১৯৮ বিশ্বনেতার দৃঢ় সমর্থন