আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: ‘মধুর যন্ত্রণায়’ একুশে পদক পাওয়া দই বিক্রেতা জিয়াউল হক । সমাজসেবায় অবদান রাখায় বেসামরিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক পেয়েছেন ”দই বেচে বই বিতরণ” করা চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হক। মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পদক নিয়েছেন তিনি। রাতেই ঢাকা থেকে বাসে চেপে চাঁপাইনবাবগঞ্জে রওনা দেন।
পৌঁছান বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকালে। রাতভর বাসযাত্রার ধকল গেলেও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাননি ৯১ বছর বয়সী এই সমাজসেবী। সারা দিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁর বাড়িতে যান। ক্লান্ত শরীর নিয়েও তিনি হাসিমুখে সবার সঙ্গে কথা বলেন। জিয়াউল হক বলেন, ‘ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া শরীরে বল নেই। কিন্তু মনে বল নিয়ে হাসিমুখে সবার সঙ্গেই কথা বলেছি। এ যেন এক মধুর যন্ত্রণা। মনে হয়েছে, রাজ্য জয় করে আসা মানুষ আমি। তাই মানুষের সঙ্গে কথা বলতে কোনো বিরক্তি বোধ করিনি।’
স্বজনেরা জানান, ঢাকা থেকে ফেরার পর অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাতে আত্মীয়স্বজন, গ্রামবাসীসহ প্রশাসনের লোকজনও জিয়াউলের বাড়িতে আসেন। বাড়ির পাশের বিদ্যালয় মুসরীভূজা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এসে একুশের শোভাযাত্রা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বললে জিয়াউল সেখানে যান। সেখানে জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান ও পুলিশ সুপার ছাইদুল হাসান ফুলের তোড়া দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে আসেন। জেলা প্রশাসক তাঁকে বই উপহার দেন। এ সময় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অন্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। পরে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও তাঁকে সম্মাননা জানানো হয়। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি বাড়িতে আসা মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
জিয়াউল হকের স্ত্রী বলেন, ‘রাতের বাসে স্বামীর বাড়িতে ফেরার কথা শুনে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। সকালে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাড়ির সামনে রাস্তায় গাড়ি থেকে নামতেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। বাড়িতে এসে তিনি প্রথমেই স্বর্ণপদকটি আমার গলায় পরিয়ে দেন। আনন্দে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যায়। জীবনে এমন অনুভূতি কাউকে বোঝাতে পারব না।’
অনুষ্ঠান মঞ্চে পদক গ্রহণের জন্য জিয়াউল হকের নাম ঘোষণার সময় উপস্থিত অতিথিরা দাঁড়িয়ে এবং করতালি দিয়ে সম্মান জানান। এ সময় তার সম্পর্কে বলা হয়, মোঃ জিয়াউল হক একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। জন্মসূত্রে অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে ছোটবেলা থেকেই স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে জীবনসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হন। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। শুরু করেন দইয়ের ব্যবসা। এরপর সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরে এলে দই বিক্রির লভ্যাংশের টাকা দিয়ে গরিব, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি গরিব, অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি তিল তিল করে গড়ে তোলেন তার পারিবারিক লাইব্রেরি। একজন সাধারণ মানুষ হয়েও নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও মানবসেবায় ব্রতী হয়ে যে সাধারণ চিন্তা করেছেন তা এই সমাজে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
জিয়াউল হকের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বড় ঘোষণা
একুশে পদকপ্রাপ্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের দই বিক্রেতা মো. জিয়াউল হকের পাঠাগারের জন্য জমি এবং ভবন তৈরি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি তার স্কুলটিকে সরকারিকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ একুশে পদক প্রবর্তন কখন কিভাবে জানুন
দই বেচে বই বিতরণ
জিয়াউল হকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার চামামুশরীভুজা গ্রামে। দই বেচে তিনি এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে গৌরব অর্জন করেছেন। ‘বেচি দই, কিনি বই’ স্লোগানের রূপকার এ মানুষটি কেবল শিক্ষার আলো ছড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন সমাজসেবায়।
জানা গেছে, জিয়াউল হক লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। পরিবারের অভাব ঘুচাতে স্কুলের পথ আর মাড়ানো হয়নি। নেমে পড়েন দুধ বিক্রিতে। কিন্তু মনের মধ্যে স্কুলে না যাওয়ার আক্ষেপটা থেকেই যায়। আর তাইতো পরিশ্রমের মজুরি থেকে এলাকার গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বইসহ অন্যান্য উপকরণ কিনে দিতেন। এভাবে শিক্ষার আলো ছড়ানো শুরু করেন মানুষটি। গড়ে তোলেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’।
স্থানীয়রা জানান, মরহুম তৈয়ব আলী মোল্লা ও শরীফুন নেসা দম্পতির ছেলে জিয়াউল হকের জন্ম ১৯৩৮ সালে। দুধ বিক্রির পাশাপাশি দইয়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। দইয়ের ব্যবসায় লাভ বেশি হওয়ায় প্রতিদিনের পরিবারের খরচ মিটিয়ে বাকি অর্থ দিয়ে নেমে পড়েন সমাজসেবায়। প্রতিদিন দই মাথায় নিয়ে সাইকেলে করে বিক্রি করেছেন গ্রামে-গঞ্জে। তার তৈরি দইয়ের নামডাকও দেশজুড়ে। আর দই বিক্রির টাকা থেকে কিনতেন দু-একটি বই অথবা পত্রপত্রিকা। আর এভাবেই ১৯৬৯ সাল থেকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’।
শুরুর দিকে অভাবগ্রস্ত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিতেন। বর্ষ শেষে আবার ফেরত নিয়ে আসতেন। পরবর্তীতে স্থানীয় হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় পাঠ্যবই, পবিত্র কোরআন মাজিদ ও এতিমদের পোশাক, শীতবস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রাখেন। পবিত্র ঈদে দুস্থদের মধ্যে কাপড় বিতরণ করেন। এ ছাড়া গ্রামের বিভিন্ন ছিন্নমূল মানুষকে টিনের ঘরও তৈরি করে দেন। এতিমখানায় পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির খাসি কিনে দেন। এভাবেই তিনি সমাজসেবা করে আসছেন।
আপাদমস্তক সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জিয়াউল হকের পাঠাগারে ২০ হাজারের বেশি বই আছে। দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তি ও সংস্থা তাকে বই ও সেলফ দিয়ে সহায়তা করেছেন। শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী জিয়াউল হক তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননাও পেয়েছেন।
এদিকে, জিয়াউল হকের একুশে পদক প্রাপ্তিতে আনন্দে ভাসছে ভোলাহাটসহ পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। তাকে অনেকেই অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এ ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদকের জন্য তালিকা প্রস্তুত করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে আমি যোগাযোগ করি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) এ কে এম গালীভ খানের সঙ্গে। এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ভোলাহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে যাই।
তিনি আরও বলেন, তৎকালীন ইউএনও আমার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠান। এরপর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালের ২১শে পদকের জন্য আমার নাম ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুনঃ একুশে পদক পাচ্ছেন দই বিক্রেতা জিয়াউল হকসহ ২১ বিশিষ্টজন