ভূতের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
ভূত বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা মানুষের মনোভাব, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের অংশ হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে উপস্থিত। প্রাচীনকাল থেকে মানবসমাজে ভূতের অস্তিত্ব সম্পর্কে নানা গল্প শোনা যায়, কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে ভূত নিয়ে কিছু দৃশ্যমান প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভূতের অস্তিত্ব এক প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় এবং এর পিছনে অনেক মনস্তাত্ত্বিক, শারীরিক এবং পরিবেশগত কারণ থাকতে পারে। চলুন, ভূতের বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করি এবং জানি, আসলেই ভূত (Ghost) কি?
১। ভূতের ধারণা: মানসিক অবস্থার প্রভাব
ভূতদের সম্পর্কে ধারণা অনেকাংশে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। দুঃখ, ভয়, শোক, অথবা মানসিক চাপে থাকা অবস্থায় মানুষ অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা অনুভব করে। একে “পারসেপচুয়াল হালুসিনেশন” বলা হয়, যেখানে ব্যক্তি তার বাস্তব অনুভূতি থেকে দূরে সরে গিয়ে কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনা অনুভব করে। যেমন, একাকিত্ব বা গভীর মানসিক অবস্থা মানুষের মনের মধ্যে নানা ধরনের অদৃশ্য বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষ করে রাতে একাকী সময় কাটালে বা শোকের পরিস্থিতিতে, মানব মস্তিষ্ক বেশিরভাগ সময় অতিরিক্ত অ্যালার্ট (সতর্ক) অবস্থায় থাকে এবং এতে নানা রকম অনুভূতি বা দৃষ্টি বিভ্রম তৈরি হতে পারে। ফলে, একে ভূতের উপস্থিতি হিসেবে ভুলভাবে মনে করা হতে পারে।
২। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড” এবং ভূত
অন্য একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হল— ভূত বা অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করার পেছনে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড (ইএমএফ) এর ভূমিকা। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, কিছু নির্দিষ্ট স্থানে শক্তিশালী মেগনেটিক ফিল্ড (চুম্বকীয় ক্ষেত্র) উপস্থিত থাকতে পারে, যা মানুষকে অস্বাভাবিক অনুভূতি দিতে পারে। বিশেষ করে, 7 থেকে 9 হার্জ রেঞ্জে ইএমএফ তৈরি হলে, মানুষ মাথা ঘোরানো, অস্বস্তি, এমনকি অদৃশ্য শক্তির অনুভূতি পেতে পারে। অনেক সময়, অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে এমন জায়গাগুলোতে এই ধরনের ফিল্ড বেশি উপস্থিত থাকতে পারে।
গবেষকরা জানান, এমনকি “সিডনি পমেরা” নামক এক বিজ্ঞানী তার এক গবেষণায় প্রমাণ করেন, যে স্থানগুলিতে অধিক ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড থাকে, সেখানে বাসিন্দাদের মধ্যে ভূতের উপস্থিতির অনুভূতি তৈরি হতে পারে। এটি প্রমাণ করে যে, ভূতের অনুভূতি মূলত পরিবেশগত কারণে হতে পারে, যা মানুষের মস্তিষ্কের কাজের সাথে সম্পর্কিত।
৩। “অবজেক্টিভ বাস্তবতা” এবং পরিবেশের প্রভাব
একটি আকর্ষণীয় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল “অবজেক্টিভ বাস্তবতা” তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, আমরা যা কিছু দেখতে বা অনুভব করি তা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। কিছু ঘটনাকে অতিপ্রাকৃত মনে হলেও, তা প্রকৃতপক্ষে পরিবেশের কিছু পরিবর্তনীয় উপাদান হতে পারে। যেমন, কিছু জায়গায় মাকড়সার জাল, বাতাসের প্রবাহ বা স্থানিক পরিবর্তনের কারণে কিছু অদ্ভুত দৃশ্য বা শব্দ তৈরি হতে পারে, যা ভূত হিসেবে মানুষের কাছে দেখা যায়।
এছাড়াও, জায়গার ভূতুরে অনুভূতির সাথে পরিবেশের লাইটিং (আলো), আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, এবং ঘর বা জায়গার আর্কিটেকচারও ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত, পুরনো বাড়িঘর বা তৎকালীন দুর্গম স্থানে এই ধরনের পরিবেশগত উপাদান বেশিরভাগ সময় থাকে, যার কারণে মানুষ ভূতের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে।
৪। সাইক্রোকাইনেসিস এবং ভূত
একটি আরেকটি প্রচলিত ধারণা হলো “সাইক্রোকাইনেসিস” (PsychoKinesis), যা মানুষের মনোবল দিয়ে কোনো বস্তু বা পরিবেশের অবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষমতাকে বুঝায়। যদিও এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়, তবে অনেক সিনেমা, গল্প ও রূপকথায় মানুষের মনোবল বা ইচ্ছাশক্তির দ্বারা অদৃশ্য শক্তির সাথে সম্পর্কিত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি মনস্তাত্ত্বিকভাবেই বিশ্লেষিত হতে পারে এবং এমনও হতে পারে, যে অজ্ঞাত শক্তির কারণে আমাদের মস্তিষ্ক কিছু অতিরিক্ত ধ্বনি বা আন্দোলন অনুভব করে।
আরও পড়ুনঃ
❒ শেষ দেখা
❒ পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গল্প
❒ ফেসবুক তারুন্যের অপমান ও প্রযুক্তির অপব্যবহার
❒ ১২ নিয়ে বাড়াবাড়ি
৫। বিজ্ঞান এবং ভূতের সাংস্কৃতিক ধারা
বিজ্ঞানীয় গবেষণা ছাড়াও, বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ভূতের ধারণা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অনেক সমাজে ভূত, আতঙ্ক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির উপস্থিতি নিয়ে আখ্যান প্রচলিত রয়েছে। এ কারণে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ ভূতের ঘটনাকে বিশ্বাস করেন এবং নানা ধারণার ভিত্তিতে ভয় পান। বাস্তবে এটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া, যাকে অভ্যস্ত সমাজ বা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত করা হয়।
এখনো ভূত বা অতিপ্রাকৃত শক্তির উপস্থিতি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলি এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যে, ভূতের অভিজ্ঞতা মূলত মনস্তাত্ত্বিক, পরিবেশগত এবং অন্যান্য বাস্তব কারণে হতে পারে। এটি অতিপ্রাকৃত না হয়ে বরং আমাদের মস্তিষ্কের কিছু অজানা কাজের ফলাফল হতে পারে। তাই, ভূত নিয়ে ভয় পাওয়ার থেকে আমাদের গবেষণা এবং জ্ঞান অর্জন করা উচিত, যা সত্যিকারভাবে আমাদের চিন্তাভাবনা আরও পরিষ্কার করবে।
লেখা: কবীর হুমায়ুন
❑ পাঠকের দৃষ্টি ও চশমা থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ আইসিটি ওয়ার্ল্ড নিউজ এর তেরো বছর পূর্তি: প্রযুক্তির জগতে এক অনন্য যাত্রা