আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: ভারতের আইনে পরিণত হলো বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল । ওয়াকফ সংশোধনী বিলে স্বাক্ষর করেছেন ভারতের প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মু। এর ফলে সংসদে পাস হওয়া বিলটি আইনে পরিণত হলো।
এর আগে গত বুধবার (২ এপ্রিল) গভীর রাতে সরকার ও বিরোধী পক্ষের দীর্ঘ বিতর্কের পরে লোকসভায় ৫৬ ভোটের ব্যবধানে পাস হয় ওয়াকফ সংশোধনী বিল। বিলটির পক্ষে ছিল ২৮৮টি ভোট আর বিপক্ষে ২৩২টি। এর পরে ১২৮-৯৫ ভোটে রাজ্যসভায় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে পাস হয়েছিল এই সংশোধনী বিল। পরে লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাস হওয়া বিল অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতি ভবনে। শনিবার (৫ এপ্রিল) প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মুর স্বাক্ষরের পর বিলটি আইনে পরিণত হলো।
ভারত সরকারের গেজেটিয়রে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে সংশোধনী আইনের বিজ্ঞপ্তি। সংশোধিত আইন অনুযায়ী ‘ওয়াকফ’ শব্দের অর্থ ‘ঐক্যবদ্ধ ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা ও উন্নয়ন’। নতুন আইন অনুসারে, তাই কোনও জমি ওয়াকফ কি না, সেই সম্পর্কিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসক। বোর্ডে এ বার থেকে থাকতে পারবেন অমুসলিম প্রতিনিধিরাও। তবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারেরও নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
ওয়াক্ফ কী
ওয়াক্ফ হলো ইসলামি দানের একটি প্রাচীন ব্যবস্থা। ওয়াক্ফের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি স্থায়ীভাবে সাধারণত জমির মতো কোনো সম্পত্তি ধর্মীয় বা জনহিতকর কাজে ব্যবহারের জন্য দান করেন। এ ধরনের ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রি করা বা কারও নামে হস্তান্তর করা যায় না।
ভারতে ওয়াক্ফ বোর্ডগুলোর অধীন প্রায় ৮ লাখ ৭২ হাজারটি সম্পত্তি আছে। এগুলোর মোট আয়তন প্রায় ১০ লাখ একর। এসবের মোট মূল্য প্রায় ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার বলে ধারণা করা হয়। এসব সম্পত্তির অনেকগুলোর ইতিহাস শত শত বছর পুরোনো। অধিকাংশই ব্যবহার করা হয় মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও এতিমখানার মতো জনকল্যাণমূলক কাজে।
নতুন আইন ওয়াক্ফ পরিচালনা বদলে দেবে
ভারতে ওয়াক্ফ সম্পত্তি পরিচালনা করে আধা সরকারি বোর্ড। এই বোর্ড প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে আলাদাভাবে গঠিত। নতুন আইনে বলা হয়েছে, এসব বোর্ডে অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক হবে।
এখন পর্যন্ত ওয়াক্ফ বোর্ডে কেবল মুসলিমরাই সদস্য হন। ভারতে অন্য ধর্মীয় দাতব্য সংস্থাগুলোও নিজ নিজ ধর্মাবলম্বীদের দিয়েই পরিচালিত হয়।
সংসদীয় বিতর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, অমুসলিম সদস্যরা কেবল প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন এবং সম্পত্তি পরিচালনায় সহায়তা করবেন। ধর্মীয় বিষয়ে তাঁরা হস্তক্ষেপ করবেন না। তিনি বলেন,‘অমুসলিম সদস্যরা শুধু নজরদারি করবেন যে বোর্ড আইন মেনে চলছে কি না আর দানকৃত সম্পত্তি যথাযথ কাজে লাগছে কি না।’
তবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মতো সংগঠনগুলো বলছে, এই বক্তব্য ইসলামি ওয়াক্ফ ব্যবস্থার মূল চেতনার পরিপন্থী। তাদের মতে, ওয়াক্ফ বোর্ডের পরিচালনা মুসলমানদের দ্বারাই হওয়া উচিত। তারা একে মুসলিম নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। এই বিলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছে এই বোর্ড।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘যখন হিন্দু মন্দির পরিচালনা কমিটিতে অন্য ধর্মাবলম্বীরা স্থান পান না, তখন ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিমদের রাখা হবে কেন?’
সবচেয়ে বিতর্কিত পরিবর্তনগুলোর একটি হলো মালিকানাসংক্রান্ত নিয়মে পরিবর্তন। এর ফলে বহু পুরোনো মসজিদ, দরগাহ বা কবরস্থানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, বহু সম্পত্তিই একসময় মৌখিকভাবে বা কাগজপত্র ছাড়াই ওয়াক্ফ হিসেবে দান করা হয়েছিল। এসবের অনেকেরই কোনো আইনি নথি নেই, যেগুলো কয়েক দশক বা এমনকি শত শত বছর আগের।
মালিকানা নিয়ে শুরু হবে দ্বন্দ্ব
নতুন আইনের অন্য পরিবর্তনগুলো শত শত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ওয়াক্ফ জমির ওপর গড়া মসজিদগুলোর ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। চরমপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো ভারতের নানা প্রান্তে বেশ কিছু মসজিদের ওপর তাদের মন্দির আছে বলে দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি, এসব মসজিদ পুরোনো হিন্দু মন্দির ভেঙে তৈরি। এ ধরনের অনেক মামলা আদালতে বিচারাধীন।
নতুন আইন অনুযায়ী, এখন থেকে ওয়াক্ফ বোর্ডকে তাদের জমির মালিকানা প্রমাণ করতে জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার অনুমোদন নিতে হবে। সমালোচকদের মতে, এর ফলে বোর্ডের ক্ষমতা খর্ব হবে। আর তা মুসলমানদের জমি কেড়ে নেওয়ার পথ তৈরি করবে। বোর্ডগুলোকে কতবার এই রকম জমির দাবির বৈধতা প্রমাণ করতে বলা হবে, তা-ও স্পষ্ট নয়।
বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী এক্সে লিখেছেন, ‘ওয়াক্ফ (সংশোধনী) বিল মুসলিমদের কোণঠাসা করার এবং তাঁদের ব্যক্তিগত আইন ও সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নেওয়ার হাতিয়ার।’ তিনি এটিকে সংবিধানের ওপর ‘আক্রমণ’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘বিজেপি এবং তাদের মিত্ররা এখন মুসলিমদের নিশানা করছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এটি অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে।’
মুসলমানদের উদ্বেগ
অনেক মুসলমানই স্বীকার করেন যে ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে দুর্নীতি, দখলদারি আর অব্যবস্থাপনা রয়েছে। তবে তাঁরা আশঙ্কা করছেন, নতুন আইনের ফলে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার মুসলিমদের সম্পত্তির ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। আর এখন তো ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে।
নরেন্দ্র মোদির শাসনে মুসলমানরা প্রায়ই টার্গেট হচ্ছেন। তাঁদের খাবার, পোশাক, এমনকি হিন্দু-মুসলিম বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়েও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তাঁরা।
আরও পড়ুনঃ
❒ বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৮০৯ কোটি
❒ গাজায় নির্মম হত্যাযজ্ঞের শেষ কোথায়?
❒ স্কুলের লাজুক ছেলে রতন টাটা হয়ে গেলেন প্রখ্যাত শিল্পপতি
❒ সেনাবাহিনীর যে বার্তায় ‘পালিয়ে যান’ শেখ হাসিনা : রয়টার্সের প্রতিবেদন
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন (ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলেজিয়াস ফ্রিডম) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানায়, ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত নির্বাচনের সময় মোদি ও তাঁর দল মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে ‘ঘৃণা ছাড়ানো বক্তব্য’ ও ‘ভুল তথ্য’ ছড়িয়েছে।
তবে ভারতের সরকার বলছে, দেশটি গণতান্ত্রিক নীতিতে পরিচালিত হয় এবং সেখানে কারও সঙ্গে কোনো বৈষম্য নেই।
ভারতের মোট ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১৪ শতাংশ মুসলমান। তাঁরা ভারতের সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হলেও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। ২০১৩ সালের এক সরকারি জরিপে দেখা গেছে, মুসলমানরা দেশটির সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি।
❑ আন্তর্জাতিক থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানলের বিপজ্জনক ধোঁয়া থেকে বাঁচতে ঘরে থাকার পরামর্শ