বিশ্বব্যাপী সংঘাতের জন্য আমেরিকার ভূমিকা: ইতিহাস এবং পরিণতি
আমেরিকার বিশ্বে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক গভীর এবং জটিল। যেহেতু আমেরিকা বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, তাই তার কর্মকাণ্ড এবং সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সংঘাতের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে তুলে ধরা হলো:
১। বিশ্বযুদ্ধ এবং সামরিক হস্তক্ষেপ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫): যদিও আমেরিকা প্রথম দিকে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছিল, ১৯৪১ সালে পर्ल হারবার আক্রমণের পর তারা সরাসরি যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধের পর, আমেরিকা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরো বেশি সক্রিয় হয় এবং বিশ্বশক্তি হিসেবে তার অবস্থান শক্তিশালী হয়। তবে, বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা সারা বিশ্বে তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে।
২। শীতল যুদ্ধ (Cold War)
রাশিয়া ও আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) বিশ্বের দুই প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে। এই সময়ে, আমেরিকা তার জোটবদ্ধ দেশগুলোর মাধ্যমে কমিউনিজম বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল, যা অনেক দেশে অস্থিরতা ও যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন:
কোরীয় যুদ্ধ (১৯৫০-১৯৫৩): আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়ার সমর্থনে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কিত উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৫-১৯৭৫): আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধের মধ্যে নাক গলায়, যেখানে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
৩। ইরাক যুদ্ধ (২০০৩)
পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত যুদ্ধ: আমেরিকা এবং তার মিত্ররা ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করেছিল, প্রধানত অভিযোগ ছিল যে ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র (WMDs) তৈরি করছে। যদিও পরবর্তীতে সেই অস্ত্র পাওয়া যায়নি, এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইরাকের পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ প্রায় ২ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আমেরিকার এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে।
৪। আফগানিস্তান যুদ্ধ (২০০১-২০২১)
৯/১১ আক্রমণের প্রতিক্রিয়া: ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় সন্ত্রাসী আক্রমণের পরে, আমেরিকা আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। ২০ বছর পর, ২০২১ সালে, আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে, তবে এই যুদ্ধের দীর্ঘ মেয়াদ, বহু ক্ষতি এবং আফগান জনগণের উপর এর প্রভাব ব্যাপকভাবে দেখা গেছে।
৫। গোপন যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান
অফিসিয়াল বা আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ছাড়াও: আমেরিকা সারা বিশ্বে গোপন বা সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানে অংশ নিয়েছে, যেমন: পাকিস্তানে ড্রোন হামলা, সিরিয়ায় আইএসআইএস বিরুদ্ধে অভিযান, এবং লিবিয়া ও সোমালিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ। এসব কার্যক্রমও অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধের রূপ নিতে পারে এবং এভাবে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
৬। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
বিশ্ব রাজনীতির প্রতি প্রভাব: আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি এবং বিদেশি নীতির কারণে অনেক দেশেই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকার অর্থনৈতিক সাহায্য বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, কখনো কখনো যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণ হতে পারে।
৭। আন্তর্জাতিক অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে হস্তক্ষেপ: আমেরিকা বহুবার বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করেছে, যেমন লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার কিছু অঞ্চলে। এতে এসব অঞ্চলে দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং হিংসা সৃষ্টি হয়েছে।
৮। বিশ্বে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া এবং নেতৃত্ব
আমেরিকা নিজেকে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দায়িত্বশীল বলে দাবি করে, তবে অনেক সময় তাদের সিদ্ধান্ত, শক্তির প্রয়োগ বা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সংঘাত ও যুদ্ধ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
আরও পড়ুনঃ
❒ ভূতের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
❒ আইসিটি ওয়ার্ল্ড নিউজ এর তেরো বছর পূর্তি: প্রযুক্তির জগতে এক অনন্য যাত্রা
❒ ফেসবুক তারুন্যের অপমান ও প্রযুক্তির অপব্যবহার
❒ পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গল্প
নিষ্কর্ষ
আমেরিকা বিশ্বে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, এর সামরিক হস্তক্ষেপ অনেক সময়েই যুদ্ধ বা অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের জন্য আমেরিকার দায় কিছুটা হলেও অপরিসীম, তবে এ কথা বলাও ঠিক হবে না যে শুধুমাত্র আমেরিকা যুদ্ধের জন্য দায়ী। অনেক সময় বিশ্বব্যাপী জটিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামরিক পরিস্থিতি এসব সংঘাতের সৃষ্টি করে।
তবে, মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে সব দেশের উচিত নিজেদের শক্তি এবং ক্ষমতা মানব কল্যাণে ব্যবহার করা, যাতে পৃথিবী শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
লেখা: কবীর হুমায়ুন
❑ পাঠকের দৃষ্টি ও চশমা থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের কারণ এবং মানব সমাজের সংকট