বিজয়ের ৫৪ বছর পরে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা
আজ মহান বিজয় দিবস। তবে একদিনে আসেনি এই বিজয়। বহু সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে এবং এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই মাসের ১৬ তারিখ আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। পৃথিবীর প্রায় সকল স্বাধীন দেশেরই স্বাধীনতা দিবস থাকলেও অনেক দেশেরই বিজয় দিবস নেই। বাঙালি জাতি বছরের পর বছর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে।
১৯৭১ সালের এ দিনে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। এ বছর আমরা দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের ৫৪ বছর উদযাপন করছি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে স্নাত, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম এবং কোটি কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ’৭১-এর এ দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নজিরবিহীন ও বিরল ঘটনা প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনাসদস্য, আরও কয়েক সপ্তাহ যুদ্ধ চালানোর মতো অস্ত্র-গোলাবারুদ ও রসদসামগ্রী থাকার পরও বিনাশর্তে লক্ষ জনতার সামনে আত্মসমর্পণ করে।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। সেদিন জাতি নির্ভয়ে গেয়ে উঠেছিল বিজয়ের অবিনাশী গান। আমরা আজ শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছি পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া শহীদদের।
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস শুধু একাত্তরেই সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে স্ফুরিত জাতীয় চেতনার পথ ধরে ধারাবাহিক সংগ্রামে ১৯৬৯ সালে ঘটে গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকার আদায়ের গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে তত্কালীন পাকিস্তানে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটে।
কিন্তু সেই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে রক্তস্রোতে ভাসিয়ে দিতে চায়, শুরু করে গণহত্যা। সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ ধরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।
স্বাধীনতাত্তোর ৫৪ বছরে নানা বিষয়ে আমাদের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি এবং অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু এসব উন্নতি এবং অগ্রগতির অন্তরালে একটি নির্মম সত্য আছে—যে আশা নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন সেই আশা এখনও পূরণ হয়নি। মানুষের মৌলিক অধিকার অর্থাৎ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার নিশ্চিত হয়নি। একটি সুস্থ, সবল ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠেনি।
৫৪ বছর পর, এই দিনটি শুধুমাত্র এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত নয় বরং একটি নতুন দিগন্তের সূচনা। এই দিনটি জাতির নিকট প্রত্যাশার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৭১ সালে অনেক স্বপ্ন নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ যে বিজয় অর্জন করেছিল, সে স্বপ্ন বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে বাংলার জনগণ এক বুক স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর বাংলাদেশ। যেখানে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, থাকবে না কোনো ভেদাভেদ। সকল নাগরিক তার মৌলিক অধিকারসমূহ ভোগ করতে পারবে।
ঠিক একইরকম স্বপ্ন নিয়ে ২০২৪-এ এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এটিও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাহিরে নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আজও আমাদের অনেক স্বপ্নই অধরা। এখন, ৫৪ বছর পর, বাংলাদেশের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের জনগণ এমন এক সমাজ চায় যেখানে থাকবে না কোনো প্রকার বৈষম্য। যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে সুশাসন ও ন্যায়বিচার।
আরও পড়ুনঃ
❒ শ্রমিকদের অধিকার রক্ষাই এ দিবসের মূল দাবি
❒ একযুগ পূর্তিতে আইসিটি ওয়ার্ল্ড নিউজ
❒ একযুগ পূর্তিতে আইসিটি ওয়ার্ল্ড নিউজ
❒ ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে …
আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই যেখানে আবাসন সংকট, বেকারসমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি, চোরাচালান, মাদকসহ সকল প্রকার অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দূরীভূত হোক। গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দরে শান্তির দূতাবাস সৃষ্টি হোক। মানুষ চলাচল করুক স্বাধীনভাবে, মত প্রকাশ করুক নির্ভয়ে, উঠতি বয়সী মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাতায়াত করুক নির্ভয়ে-নির্ঝঞ্ঝাটে, শহরে-গ্রামে সর্বত্র বখাটেপনা নির্মূল হোক, নারী নির্যাতন দূর হোক, মাদকের ছোবল থেকে ছেলে-মেয়েরা দূরে থাকুক। আমাদের কোনো ভাইবোন যেন বেকার সমস্যার জন্য তাদের মূল্যবান জীবন নষ্ট না করে এজন্য নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। একই সাথে শিক্ষার মানোন্নয়ন করাও জরুরি।
বিজয়ের ৫৪ বছর আমাদেরকে একটি শক্তিশালী জাতি হওয়ার পথ দেখিয়েছে। কিন্তু এ যাত্রার মূল লক্ষ্য অর্জনে একে অন্যকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে একটি উন্নত, দারিদ্র্যমুক্ত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব। বিজয়ের এ আদর্শকে ধারণ করে, দেশবাসী একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমরা গড়তে পারি এক নতুন বাংলাদেশ যা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য এক শক্তিশালী ভিত্তি।
তবুও প্রতিবছর বিজয় দিবস আমাদের জীবনে আসে নতুন প্রেরণা নিয়ে। সেই প্রেরণার আন্দোলিত আহবানে নতুন স্বপ্নে বিভোর প্রত্যাশিত বাংলাদেশের এই প্রজন্মকে জানাই বিজয় দিবসের রক্তিম শুভেচ্ছা।
❑ সম্পাদকীয় থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে নিকৃষ্ট অধ্যায়