আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য পালকি । ‘হুন হুনা হুন হুনরে’ বা ‘চার বেহারার পালকি চড়ে যায় রে কন্যা পরের ঘরে’। পালকির বেহারাদের এই ছন্দ তোলা গানগুলো এখন আর শুনতে পাওয়া যায় না গ্রাম বাংলার মেঠোপথে। হাজার বছরের ঐতিহ্য পালকিকে এখন আর মেঠোপথে চলতেও দেখা যায় না। কালের বিবর্তনে পালকি জাদুঘর ও বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পালকির পরিচয় নেই বললেই চলে। তারা পালকির কথা বইয়ের পাতায় এবং লোক ও কারু জাদুঘরে গিয়ে দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু আগের দিনে বিয়ের বরযাত্রায় পালকির ছিল একটি ভিন্ন জলুস। বর পালকি চড়ে কনের বাড়ি যেত, আবার কনেও পালকি চড়ে শ্বশুরবাড়ি আসত।
আরও পড়ুনঃ লালবাগ কেল্লা, ঢাকা
গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য পালকি। বিয়ে উৎসবে পালকির কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। একটা সময় ছিল বিয়েতে পালকি চাই। গ্রামীণ আঁকা-বাঁকা মেঠো পথে, কখনও আলপথে বর-কনে পালকি চড়ে উভয়ের শ্বশুর বাড়িতে আসা-যাওয়ার আনন্দঘন একটা দারুণ সময় ছিল। বিয়ের বর-কনেকে পালকিতে তুলে বেহারারা বয়ে নিয়ে চলত। তাদের মুখ থাকতো ছন্দের ‘হুনহুনা’ ‘হুনহুনা’ সুর। গাঁও-গ্রামের পথে পালকিতে করে নববধূকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে মন জুড়াত গাঁওয়ের বধূ, কখনও মা-চাচি, উঠতি বয়সের চঞ্চল মেয়েরাও বাদ পড়েনি।
হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ‘পালকি’। একসময়ে বিয়ের বর-কনে বাহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পালকি। গ্রামের পথে ভেসে আসছে ‘হুনহুনা’ ‘হুনহুনা’ ধ্বনি। তালে তালে পা ফেলে, সুরেলা ছন্দময় ধ্বনি ছড়িয়ে তারা পালকিতে বয়ে নিচ্ছে নব বধূ কিংবা বর। রঙিন ঝালর দেয়া আর নানা রঙের ফুল ও কাগজে সাজানো পালকির ভেতর ঘোমটা দেয়া বধূর মুখখানি দেখতে আশপাশের মানুষ এসে দাঁড়ায় রাস্তার পাশে। লাজুক মুখে নববধূও দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ ফেলে বাইরে। এখন আর সেই আবিষ্ট করা হুনহুনা ধ্বনি ভেসে আসে না কোথাও। কালপরিক্রমায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন পালকি আজ বিলুপ্তির পথে।
আরও পড়ুনঃ রূপসা জমিদার বাড়ি, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর
সংস্কৃত ‘পল্যঙ্ক’ বা ‘পর্যঙ্ক’ থেকে বাংলায় উদ্ভূত ‘পালকি’। বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য “পালকি” বিভিন্ন আকৃতি ও ধরনের হয়ে থাকে। সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ দিয়েও বানানো হতো পালকি। বটগাছের বড় ঝুরি দিয়ে তৈরি করা হতো পালকির বাঁট।
সাধারণত তিন ধরনের পালকি বানানো হতো। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি ও ময়ূরপঙ্খী পালকি। সবচেয়ে ছোট পালকি ‘ডুলি’ বহন করে দুই বেহারা। বড় পালকি চলে চার বেহারা ও আট বেহারায়।
ইতিহাস বলছে, একসময় শুধু বধূ বহন নয়, অভিজাত শ্রেণির মানুষ ও রাজরাজড়াদেরও প্রধান বাহন ছিল পালকি। সেই পালকির ছিল কত না রূপ, কত না রকম। পালকির ব্যবহার কখন কিভাবে এদেশে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে মোগল ও পাঠান আমলে বাদশাহ, সুলতান, বেগম ও শাহাজাদীরা পালকিতে যাতায়াত করতেন।
হাজার হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে পালকির প্রচলন ছিল। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, এর বাইরেও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পালকির প্রচলন ছিল। প্রাচীন রোমে পালকিকে বলা হতো লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো ও তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত ছিল। এমনকি ব্রিটেনের রাজা ও লেখক অষ্টম হেনরি আমৃত্যু পালকিতে চড়েছেন বলে জানা যায়।
দেশি-বিদেশি পরিবাহক ও ঐতিহাসিকদের তথ্য ও গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু ও ১৯৩০-সালে শহরাঞ্চলে রিক্সার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যান জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
কালে-ভদ্রে কেউ কেউ শখের বশে কিংবা অনুষ্ঠানে ভিন্নতা আনতে পালকির খোঁজ করেন। তবে নগর জীবনে আজকাল কদর বেড়েছে পালকিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার।
নতুন প্রজন্ম লোকশিল্প জাদুঘরে গিয়ে সাজানো গোছানো কৃত্রিম পালকি দেখবে। পালকির সেই ঐতিহ্যময় হাজার বছরের ব্যবহার ক্রমে গ্রাস করেছে যান্ত্রিক সভ্যতার বিদেশি বিভিন্ন রঙের বাহারি গাড়ি। পালকি বহনের দৃশ্য এখন যেন অনেকটাই স্বপ্ন। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছন্দমাখা পালকি বহনের গানও।
আরও পড়ুনঃ শালবন বৌদ্ধ বিহার, কুমিল্লা