বর্ষাকালে বাংলার প্রকৃতিতে সৌন্দর্যের মেলা বসে
আজ আষাঢ় মাসের প্রথমদিন। বৃষ্টি আর মেঘ মাসের প্রথম দিন। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরার দিন আসছে আজকে থেকে। গাছের পাতায়, টিনের চালে, কিংবা ছাদের রেলিং ছুঁয়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ার মিষ্টি-মধুর সুরের মূর্ছনা সত্যিই অসাধারণ ঋতু এ বর্ষাকাল।
আবহমান বাংলার সমৃদ্ধ প্রকৃতির এক অবারিত দান বর্ষাকাল। আমাদের জীবনযাত্রার পথে বর্ষার স্নিগ্ধ পরশ প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। বর্ষার রূপ-রস আর সৌন্দর্যে প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে। বৃষ্টি ধোয়া প্রকৃতির রূপে মন মেতে ওঠে।
বর্ষার রিমঝিম শব্দে মন হয়ে ওঠে কাব্যময়। প্রচণ্ড তাপদাহকে বিদায় জানিয়ে বর্ষা রানীর বর্ষণে সিক্ত হয় প্রকৃতি এবং প্রাণ ফিরে পায়। বয়ে যায় শীতল বাতাস। নেমে আসে প্রশান্তি। বর্ষা মৌসুমে মনোরম দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ায়, মন ভরে যায়।
গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ আর প্রখর রোদে জনজীবন যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন বর্ষার প্রার্থনা যেন অবধারিত হয়ে ওঠে। ঠিক সে সময়ই প্রকৃতিকে শীতল, সতেজ, স্নিগ্ধ, কোমল আর উজ্জ্বল করতে ঘন গৌরবে নবযৌবনে আগমন করে বর্ষাঋতু।
মরা নদীও বর্ষায় জেগে ওঠে তার রূপ-যৌবন জানান দিতে চায়। বাংলাদেশ যে নদীমাতৃক দেশ এটা পূর্ণতা পায় বর্ষাকালে। নদীর ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ, কালো জল যেন হারিয়ে যায় বর্ষার ক্ষিপ্র নাচনে। প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি।
সত্যিই বর্ষা আমাদের মনের কথা, হৃদয়ের ভাবাবেগ বুঝতে পারে; আমাদের চাওয়া-পাওয়া, অভাব-অভিযোগের কথা অনুধাবন করতে পারে। তাই তো বর্ষায় বৃষ্টি তার রিনিঝিনি নূপুর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর তালে অহর্নিশ ঝরে পড়ে বাংলার উর্বরা ভূমিতে।
আরও পড়ুনঃ গণমানুষের রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই
বর্ষাকে প্রকৃতির রানি বলা হয়। শিল্পরসিক মন বর্ষার বিচিত্রতায় অভীভূত হয়ে যায়। এক কথায় প্রকৃতিকে মন ভরে উপভোগ করতে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় বর্ষা। বর্ষায় গ্রাম বাংলার প্রকৃতি যেন তার রূপ-যৌবনে ভরা আসল সৌন্দর্য ফিরে পায়।
বর্ষা আগমনে প্রকৃতিতে দেখা মেলে সবুজের সমারোহ, যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই সবুজ বৃক্ষ হাতছানি দিতে থাকে। বর্ষার কোমলতা মানুষের হৃদয়টাকে যতটা ছুঁয়ে যায়, বাংলার আর কোনো ঋতু এভাবে ছুঁতে পারে না। তাই বর্ষা বাংলার অনন্য ঋতু।
বৃষ্টি যেমন প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ, নির্মল, সতেজ আর উজ্জ্বল করে তেমনি মানুষের মনকেও ধুয়ে মুছে করে তোলে পবিত্রময়। বর্ষাকালে নৌকা, ডিঙি, ভেলা প্রভৃতি চলাফেরা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। কৃষকরা বৃষ্টিতে ভিজে ফসল তোলার কাজে ব্যস্ত থাকে। কারণ বর্ষাকাল পাট কাটার ও ধান চাষের উপযুক্ত সময়।
বর্ষা মানে বাহারি রঙের সুগন্ধি ফুলের সমাহার। বর্ষা ঋতু যেন ফুলের জননী। বর্ষা যেন আমাদের প্রকৃতিকে আপন মনে বিলিয়ে দেয় এবং এর ফুলের সৌন্দর্য আমাদের করে তোলে বিমোহিত। আবহমানকাল ধরেই আমাদের প্রকৃতিকে বর্ষার ফুল স্বতন্ত্র সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে আসছে অনুপম উদারতায় এবং বৃষ্টিস্নাত বর্ষার ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের মন রাঙিয়ে আসছে অনাদি অনন্তকাল ধরে।
বর্ষা ও তার ফুল যেন বাংলার প্রকৃতির আত্মা; বৃষ্টিস্নাত বর্ষার ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি মানুষের মনে রং লাগিয়ে আসছে। বর্ষার শুরুতেই গাছে গাছে ফুটতে থাকে কদম ফুল। কদম ফুলের আগমনী বলে দেয় এই বুঝি বর্ষাকাল এসে হাজির হলো প্রকৃতির মাঝে। কদম ফুলের শোভাবর্ধন যেন প্রকৃতিকে বৈচিত্র্য এনে দেয়।
বর্ষার গাঢ় সবুজের সঙ্গে চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শাপলা, কদম, কেয়া, তমাল, হিজল, জারুল, করবী, সোনালু, বকুল, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, রঙ্গন, অলকানন্দ, কলাবতী, চন্দ্রপ্রভা, কামিনী, কলমি ফুল, পদ্ম, বনতুলসি, দোলনচাঁপা, ঝিঙেফুল, সোনাপাতি, কচুফুল, হেলেঞ্চা ফুল, উলটকম্বল, ঘাসফুল, শিয়ালকাঁটা, কেন্দার, কুমড়ো ফুল এবং এ ছাড়া নানা রঙের অর্কিডসহ বাহারি অনেক ফুল।
আরও পড়ুনঃ জ্বলছে সব জ্বলছে
বর্ষাকে ভালোবাসার ঋতু বললেও অত্যুক্তি হবে না। বর্ষা ছাড়া প্রকৃতি যেন পূর্ণতা পায় না। বলা যায় বর্ষা, প্রকৃতি-পরিবেশ ও সৌন্দর্য একই সরলরেখায় বাঁধা। বর্ষার মন মাতানো নৃত্য-ছন্দ মানবমনে এক রহস্যময় আবেগ সৃষ্টি করে। বর্ষার অনুপম ছোঁয়ায় আমাদের চারপাশ ধুয়ে-মুছে ঝকঝকে-তকতকে হয়ে যায়। প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় বর্ষা।
বর্ষার রূপ গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে নতুন রূপে ধরা দেয়। তাই তো গ্রামের মানুষ বর্ষাকে আরও বেশি উপভোগ করে। গ্রামের কাদাময় পথঘাটে, কৃষকের ক্ষেতে কিংবা মাঠে গ্রামের শিশু-কিশোররা কাদা মেখে ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে। পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করে বৃষ্টি উপভোগ করে।
তবে এসময় পশুপাখির মধ্যে কোনো চঞ্চলতা দেখা যায় না। তারা চোখ বন্ধ করে গাছের ডালে বৃষ্টিবিলাসে মত্ত থাকে। মেঘলা দিনে অনেকের মন মেঘলা হয়ে ওঠে। বিশেষত যারা নিঃসঙ্গ তাদের বিষণœতায় পেয়ে বসে। মন উদাসী হয়ে উড়ে যেতে চায়। চোখের কোণ বিন্দু বিন্দু জলকণায় চিক চিক করে ওঠে। কি এক ভালোলাগা যন্ত্রণায় বুক ভারি হয়ে ওঠে, অনেক গভীরে তলিয়ে যেতে থাকে।
বর্ষায় আকাশভাঙা বারিধারায় কানায় কানায় ভরে ওঠে নদ-নদী, পুকুর-নালা, হাওর-বাঁওড়সহ ছোট-বড় জলাশয়। মনের সুখে ডাকে ব্যাঙ। বৌ-ঝিরা এ সময় ঘরে বসে নকশিকাঁথা সেলাই করে। সুঁচ আর হাতের জাদুতে হেসে ওঠে সুন্দর সুন্দর নকশি কাঁথা।
বর্ষার মাঠে সবুজ ধানের শিষগুলো দুলতে থাকে আর বর্ষার রূপ কীর্তন গাইতে থাকে। খাল-বিল-পুকুরে ঝাঁক বেঁধে নানা প্রজাতির মাছের আনাগোনা চোখে পড়ে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ডোবা-নালায় শালুক কুড়িয়ে বেড়ায় আর নৌকায় বোঝায় করে শাপলা তুলে নিয়ে আসে।
উদাস করা পল্লীবধূ পালতোলা নৌকায় ঘোমটা পরা রাঙামুখ টেনে ছইওয়ালা নৌকায় বাপের বাড়ি নাইওর যায়। আর ফিরে ফিরে চায় ফেলে আসা পথ পানে। পাল তোলা নৌকা কলকল করে চলতে থাকে আপন মনে। আর মাঝি-মাল্লারা মনের সুখে ভাটিয়ালি গান ধরে।
বর্ষায় বৃক্ষপ্রেম জাগ্রত হয়ে ওঠে। বর্ষাকাল বৃক্ষরোপণ করার উপযুক্ত সময়। জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের এই সময়ে বৃক্ষসম্পদ সংরক্ষণের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ হওয়া আবশ্যক। তাই ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা-খড়া, জলোচ্ছ্বাস-পাহাড় ধস তথা পরিবেশের ভারসাম্য ও সুরক্ষার জন্য বেশি বেশি বৃক্ষ রোপণের কোনো বিকল্প নেই।
বর্ষাই তো বাংলার চিরায়ত রূপ। রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি ধারায় একসময় ক্ষেত-খামার, পথ-প্রান্তর ডুবে যায়। থৈ থৈ পানি চারদিকে। যেন নতুন সমুদ্র জেগেছে গ্রামজুড়ে। সবুজ সজিবতায় গাছপালা, বন-বনানী প্রাণ ফিরে পায়। কলার ভেলায় চড়ে আনন্দে মেতে ওঠে দুরন্ত কিশোরের দল।
আরও পড়ুনঃ কীভাবে হবেন একজন ভালো মানুষ?
খাল-বিল, পুকুর পাড়ের গাছে চড়ে ঝাঁপ দেয় পানিতে, ডুব সাঁতারে হার মানায় পানকৌড়িকেও। কেউ কেউ আবার সুউচ্চ ব্রিজ-কালভার্টের ওপর থেকেও লাফ দেয় পানিতে। চারিদিকে থৈ থৈ পানির ঢেউয়ের তালে তালে এগিয়ে চলে বাইচের নৌকা। গ্রাম বাংলার মানুষের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম নৌকাবাইচের আয়োজন থাকে বর্ষাজুড়ে। ঘরের দাওয়ায় বসে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখতে বেশ ভালোই লাগে।
আমাদের অতি প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল। বর্ষায় প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য আর আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘের ভেলা মন কেড়ে নেয়। অবারিত মাঠ, মেঘলা আকাশ, টলমলে জলের পুকুর, মাটির সোঁদা গন্ধ, ভেজা সবুজ ঘাস আর পাতার হাসি দেখতে ভালো লাগে। বর্ষার থইথই জলে টেংরা, পুটি, টাকি, কৈ, মাগুর, শোল, বোয়াল, রুই, মৃগেলসহ নানা প্রজাতির মাছের সমারোহ দেখা যায়।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে বর্ষা তথা শ্রাবণ মাসের রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের অধিকাংশ প্রজাতি যেমন আউশ, আমন, ইরি ধান এ সময় রোপণ করা হয়। এসব ধানের চারা রোপণে উপযোগি প্রয়োজনীয় সেচ বা পানির চাহিদা মেটায় বৃষ্টির পানি।
এতে কৃষকের সেচ ব্যয় বহুলাংশে কমে যায়। বর্ষাকালে নদী, নালা, খাল, বিল ইত্যাদির পানি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। এতে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও বিচরণ ক্ষেত্র বৃদ্ধি পায় এবং ফলন বাড়ে। মাছের ফলন বৃদ্ধি পেলে গ্রামীণ মৎস্যজীবী তথা চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। এছাড়া এসময় নদী পথের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়, ফলে নৌ চলাচলও সহজতর হয়।
বৃষ্টির দিনে গ্রামের কাঁচা রাস্তাঘাট হয়ে পড়ে কর্দমাক্ত। লোকজন হাঁটু সমান কাদা ভেঙে এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়াতে যান। এমন দিনে কত আর গৃহকোণে বন্দি থাকা যায়। পাশের বাড়িতে গিয়ে গল্পগুজব করে সময় পার করেন মানুষজন। প্রতিবেশী সহপাঠীদের বাড়িতে গিয়ে পুতুল, লুডু এবং ক্লাব, দোকানপাটের সামনে বিশেষ করে কাচারী ঘরে ক্যারাম-মার্বেল ইত্যাদি খেলায় মজে শিশু-কিশোররা।
বর্ষার অবসরে কোনো কোনো বাড়ির দাওয়ায় বসে বয়স্কদের তাস খেলতেও দেখা যায়। কৃষিপ্রধান বাংলার প্রয়োজনের ঋতু বর্ষাকাল। বর্ষাকাল বাংলার পরম আকাক্সিক্ষত ঋতু হলেও সে প্রতিবছর ঠিক কোথাও জনজীবনে নিয়ে আসে দুর্ভোগ আর বিপর্যয়। নবযৌবনা সুন্দরী বর্ষাও সময় বিশেষে হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর ও ভয়ংকরী।
আরও পড়ুনঃ প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগের শিক্ষা
অতিবর্ষণের কারণে নদীমাতৃক বাংলার পলি জমে থাকা নদীগুলোর পানি ফুলে ফেঁপে ওঠে, যার কারণে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও সৃষ্টি হয়। সারা দেশে ঘনিয়ে আসা মেঘপুঞ্জ আর বৃষ্টির মধুর বিড়ম্বনা বর্ষার আগমন বার্তা অবশ্য দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়ে যায়।
বর্ষার প্রকৃতিতে মহান স্রষ্টার অপরূপ সৌন্দর্যের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। বর্ষা প্রকৃতিকে যেমন সতেজ ও গতিময় করে তোলে, তেমনি মানুষের মনকে করে তোলে সহজ, সরল ও ছন্দময়। সৃষ্টিশীল চেতনাকে করে সুচারু ও তীক্ষè। বর্ষার নির্মেদ প্রকৃতি ফুরফুরে অনুভূতি জাগায় অন্তরে। উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগ তাড়িত করে সবাইকে। বর্ষার প্রকৃতি উদার, প্রেম ও ভালোবাসার সরল অনুভূতি জাগ্রত করে।
তবে বর্ষা যতই ভয়ংকর রূপ ধারণ করুক না কেন, কৃষিপ্রধান বাঙালি জনগোষ্ঠীর জীবনে বর্ষা মহান সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে আসে। বর্ষা অপূর্ব রূপশ্রী নিয়ে আগমন করে বাংলার আর্থিক সমৃদ্ধির বুনিয়াদ গড়ে তোলে। একদিকে বর্ষার কল্যাণময়ী রূপ, অন্যদিকে তার ভয়ঙ্কর প্লাবনচিত্র।
তবুও সব মিলিয়ে বর্ষা বাংলার রূপ মাধুর্যকে যতখানি বৈচিত্র্যময় করে তোলে ঠিক, তেমনটি আর কোনো ঋতুতে দেখা যায় না। শুধু বর্ষার কারণেই এদেশ সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা রূপ পরিগ্রহ করে ঠিক যেন এক রূপবতী রানি।
লেখকঃ মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর
❑ মুক্তকলাম থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ ২৫শে মার্চ ভয়াল ‘গণহত্যা দিবস’