আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: বরেণ্য কণ্ঠযোদ্ধা আব্দুল জব্বার । তিনি ছিলেন একাত্তরের একজন কণ্ঠযোদ্ধা। একজন বাংলাদেশি সঙ্গীত শিল্পী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অনেক উদ্বুদ্ধকরণ গানের গায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের শিল্পী ছিলেন আব্দুল জব্বার।
তিনি তখন ৩২ পেরোনো যুবক। কণ্ঠে সুর আর মনে দেশপ্রেম। এই সম্বল নিয়ে নেমে পড়লেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গাইলেন, ভারতে গিয়ে কিংবদন্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জনমত তৈরি করলেন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে গিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে তাদের উৎসাহ-প্রেরণা দিলেন। শুধু তা-ই নয়, দেশ স্বাধীনের পর সরকারের ত্রাণ তহবিলে নিজের আয় করা প্রায় ১২ লাখ রুপি দিয়েছিলেন তিনি!
আবদুল জব্বার ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮ সালে কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকে সঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন। তিনি মূলত আধুনিক গানের শিল্পী। সঙ্গীতকে ভালোবেসেই তিনি জীবনের পথ চলছেন। ষাট দশকে তিনি বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন।
আরও পড়ুনঃ এক জীবনে নায়করাজ রাজ্জাক
আবদুল জব্বার ১৯৫৬ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন ওস্তাদ ওসমান গনি এবং ওস্তাদ লুৎফুল হকের নিকট। ২০ বছর বয়সে, ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। বাংলাদেশের প্রথম রঙিন সিনেমা ‘সংগম’-এর গানেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি। তিনি ১৯৬২ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বিটিভির নিয়মিত গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত প্রথম রঙ্গিন চলচ্চিত্র সংগমের গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৮ সালে এতটুকু আশা ছবিতে সত্য সাহার সুরে তার গাওয়া “তুমি কি দেখেছ কভু” গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরবর্তীতে এই সংখ্যা ক্রমশ বড় হয়েছে। একই বছর ঢেউয়ের পর ঢেউ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে “সুচরিতা যেওনাকো আর কিছুক্ষণ থাকো” গানে কণ্ঠ দেন। রবীন ঘোষের সুরে তিনি পীচ ঢালা পথ (১৯৭০) ছবিতে “পীচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি” এবং নাচের পুতুল (১৯৭১) ছবির শিরোনাম গান “নাচের পুতুল”-এ কণ্ঠ দেন। ১৯৭৮ সালে সারেং বৌ চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে “ও রে নীল দরিয়া” গানটি দর্শকপ্রিয়তা পায়।
তার গাওয়া ‘পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, ‘নাচের পুতুল’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘শত্রু তুমি বন্ধু তুমি’, ‘মাটির মানুষ’ ও ‘আমি বন্দি কারাগারে’সহ বহু গান নন্দিত হয়েছে। এছাড়া ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’র মতো কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘পিচঢালা পথ’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘বিনিময়’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘মানুষের মন’, ‘আলোর মিছিল’, ‘সারেং বৌ’, ‘সখী তুমি কার’, ‘সূর্যগ্রহণ’সহ অনেক সিনেমায় গান করেছেন তিনি। ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’ শিরোনামে তার একটি অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছিল ২০১৭ সালে।
আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় জায়গা করে নেয়।
তার অন্যান্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে’, ‘বন্ধু তুমি শত্রু তুমি’, ‘বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা’, ‘তুমি আছো সবই আছে’, ‘তারা ভরা রাতে’, ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই’, ‘সুচরিতা যেও নাকো, আর কিছুক্ষণ থাকো’।
আব্দুল জব্বার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। এরমধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৮০), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৬), বাচসাস পুরস্কার (২০০৩), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস-আজীবন সম্মাননা (২০১১) ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।
আব্দুল জব্বারের প্রথম স্ত্রী গীতিকার শাহীন জব্বার যার গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্দুল জব্বার, সুবীর নন্দী, ফাতেমা তুজ জোহরার মত জনপ্রিয় বাংলাদেশি সঙ্গীতশিল্পীরা। তাদের সন্তান মিথুন জব্বারও একজন সঙ্গীতশিল্পী। জব্বারের দ্বিতীয় স্ত্রী রোকেয়া জব্বার মিতা যিনি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
৩০ আগস্ট তার চলে যাওয়ার দিন। ২০১৭ সালের এই দিনে মারা যান তিনি। প্রয়াণ দিনে তাকে ঘিরে বিশেষ কোনও আয়োজনের খবর পাওয়া যায়নি যদিও। তবে তিনি যেসব গান রেখে গেছেন কালের খেয়ায়, সেগুলো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, রাখবে; শ্রোতাদের মনে, পরম ভালোবাসায়। বিনম্র শ্রদ্ধা, বরেণ্য কণ্ঠযোদ্ধা আব্দুল জব্বার।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট
আরও পড়ুনঃ ভিনগ্রহ থেকে রেডিও সংকেত আসছে, চিন্তায় বিজ্ঞানীরা