আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: প্রথমবার হজে গেলে যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকবেন । ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ মুসলমান এই ধর্মীয় কর্তব্য পালনের জন্য সৌদি আরবে সমবেত হন।
হজ একটি আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত। দীর্ঘ এই সফরে ইবাদতের নিয়ম-কানুন জেনে নেওয়া প্রত্যেক হজযাত্রীর জন্য আবশ্যকীয়। বিশেষ করে নতুন হাজিদের কিছু ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তাদের জন্য পরামর্শমূলক কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো, যা কাজে আসবে বলে আশা করছি।
১. আপনার পাসপোর্ট, হজের নুসুক কার্ড, মুয়াল্লিম নম্বর, হোটেলের কার্ড ও টাকা-পয়সা স্বযত্নে আপনার সঙ্গেই রাখবেন। তা অন্য কাউকে দিয়ে বহন করাবেন না। তা রাখার জন্য বেল্টের ব্যাগ বা গলায় ঝোলানো ব্যাগ ব্যবহার করবেন। সফরে প্রতিটি ব্যাগে হাজির নাম ও পাসপোর্ট, এজেন্সি ও ফোন নাম্বার দিয়ে ট্যাগ ব্যবহার করবেন।
২. হজের সফরের আগে খুব ভালোমতো হজের নিয়ম-কানুন শিখে নেবেন, প্রশিক্ষণ নেবেন। হজের মাসায়েলগুলো ভালোমতো জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন। সঙ্গে একটি হজ গাইড বই রাখবেন অথবা আগে হজ করেছেন এমন অভিজ্ঞ আলেমের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবেন।
৩. ইহরাম অবস্থায় কী কী কাজ করতে পারবেন না তা অবশ্যই জেনে রাখবেন। এখানেই ভুলটা বেশি হয়। যেমন, ইহরাম অবস্থায় কোনো পশু-পাখি এমনকি কোনো পোকা মাকড় মারতে পারবেন না বা কাউকে মারার জন্য দেখিয়ে দিতে পারবেন না। এমন সময় আপনার সামনে মশা চলে এলো, আপনি অভ্যাসবশত মশা মেরে ফেললেন—এমনটা যেন না হয়। মনে রাখতে হবে, কীট-পতঙ্গ পর্যন্ত মারা যাবে না এ সময়। স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া বিবাদ, পরচর্চা ইত্যাদি বিষয় থেকে বেঁচে থাকতে হবে। ইহরাম অবস্থায় কোনো সুগন্ধি বা সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না। অনেকেই বিভিন্ন লোশন ও সাবান ব্যবহার করেন যা সুগন্ধিযুক্ত। এটি নাজায়েজ। এক্ষেত্রে সুগন্ধি ছাড়া লোশন ও ভেসলিন ব্যবহার করতে পারেন।
৪. ভালোভাবে জেনে নিন কোন কোন স্থানে দোয়া কবুল হয়। যেমন- কাবা ঘরের ভেতর, জমজমের কাছে, সাফা-মারওয়ায়, সাফা-মারওয়ার সবুজ বাতির মাঝখানে, মাকামে ইবরাহিমের কাছে, আরাফাতের ময়দানে, মুজদালিফায়, মিনায়, তিন জামারাহর পাশে, হাজরে আসওয়াদ বা কাবা শরিফের কালো পাথরে চুমু খেয়ে দোয়া করলে তা কবুল হয়।
৫. মক্কা-মদিনার দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে জেনে নেবেন। ফলে আপনার এজেন্সি যখন আপনাকে সেখানে ঘুরাতে নিয়ে যাবে তখন মনে পবিত্র এক অনুভূতি কাজ করবে।
৬. হজে যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ইবাদত। তাই নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে গিয়ে বসে না থাকলে মসজিদের ভেতর জায়গা পাবেন না। বিশেষ করে জুমার নামাজ শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে গেলে মসজিদের ভেতর ভালো জায়গা পাবেন।
৭. অনেক নারী জামাতে নামাজ পড়তে পারন না। যাওয়ার আগে শিখে নেবেন। ছেলেদের দায়িত্ব তাদের মাহরামদের জামাতে নামাজ পড়তে শিখিয়ে দেওয়া। কারণ আমাদের দেশের নারীরা মসজিদে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত নন।
৮. প্রতি ওয়াক্তে জানাজার নামাজ হয়। অনেক মহিলাই জানাজার নামাজ পারেন না। শিখে নেবেন। পড়লে ভালো।
৯. দোয়া কবুল হওয়ার স্থানে মন ভরে দোয়া করুন এবং আগে থেকে ঠিক করে রাখুন কী দোয়া করবেন। অনেক সময় আবেগের কারণে কী দোয়া করবেন তা মনে থাকে না। মন ভরে কাবা ঘর দেখে নেবেন। কারণ আপনার নসিবে দ্বিতীয়বার কাবা ঘর দেখা সম্ভব নাও হতে পারে।
১০. বিমানে ওঠার আগে থেকেই আপনার হ্যান্ডব্যাগে পাতলা জায়নামাজ এবং স্প্রে করা যায় এমন পানির বোতল সবসময় সঙ্গে রাখবেন। যাতে অজু করার জায়গা না থাকলে স্প্রে করে হাতের তালুতে পানি নিয়ে অজুর ফরজগুলো আদায় করে অজু করে নিতে পারেন।
১১. আপনাকে অনেকক্ষণ মসজিদে থাকতে হবে। তাই সঙ্গে খেজুর, বাদাম বা শুকনো খাবার রাখবেন। মনে রাখতে হবে, কোনোভাবেই আপনাকে অসুস্থ হওয়া চলবে না। এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে আপনি অসুস্থ হয়ে যান। যেমন বেশি ওমরা করতে গিয়ে অনেকে এমন অসুস্থ হয়ে যান যে ফরজ কাজ করতে পারেন না।
১২. অতিরিক্ত জিয়ারাহ বা তাওয়াফ হজের পরে করাই ভালো। প্রচুর পরিমাণে পানি ও জুস খেতে হবে। হজের সময় কমদামী এবং হালকা স্যান্ডেল ব্যবহার করবেন।
১৩. যখন মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান করবেন, তখন চেষ্টা করবেন আপনার ব্যাগের ওজন যেন কম হয়। কারণ অনেক হাঁটতে হবে এবং সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হবে।
১৪. জামারাতে (পাথর নিক্ষেপের জায়গায়) বড় ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেবে না। ব্যাগ নিয়ে ফেলে দেয় অনেক সময়। তাই সাবধান। নিক্ষেপ করার পাথর পারলে মোয়াল্লেমের মাধ্যমে আগেই সংগ্রহে রাখবেন।
১৫. আরাফার ময়দানে অনেক নিম গাছ দেখতে পাবেন। ইহরাম অবস্থায় আপনি কোনো গাছের ডাল ভাঙতে পারবেন না। কিন্তু অনেকেই গাছের ডাল ভেঙে মেসওয়াক করে। এ ব্যাপারে সাবধান। প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখবেন। বিশেষ করে মুভ, প্যারাসিটামল, অ্যাসিডিটির ওষুধ, স্যালাইন ইত্যাদি। তাছাড়া নিয়মিত কেউ যদি কোনো ওষুধ খায় সেগুলো কতদিনের প্যাকেজের জন্য যাচ্ছেন সেই হিসেবে সঙ্গে রাখবেন।
১৬. মদিনায় যখন মসজিদে কুবায় যাবেন, তখন হোটেল থেকে অজু করে যাবেন। কারণ বাসা থেকে অজু করে মসজিদে কুবায় দুরাকাত নফল নামাজ পড়লে একটা ওমরা হজের সওয়াব পাওয়া যায়।
১৭. জামারাতে যখন পাথর মারা হয় তখন অনেকেই জুতা, স্যান্ডেল, বোতল ছুড়ে মারেন। এটা করা যাবে না। গালাগালিও করা যাবে না। পাথর মারার সময় দোয়া পড়ে পাথর মারতে হবে এবং মনের ভেতর এমন একটা ফিলিংস আনতে হবে যে, ‘আমি সুন্নত অনুযায়ী ইবাদত করছি মাত্র।’ এখানেই ইবরাহিম (আ.) শয়তানকে পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন।
১৮. মদীনায় মহানবী (স).-এর রওজা শরিফে মেয়েদের সবসময় ঢুকতে দেওয়া হয় না। ফজর, জোহর ও এশার নামাজের পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঢুকতে দেয়। মেয়েদের জন্য ২৫ নং গেট দিয়ে ঢুকলে সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশসহ সব দেশের মেয়েদের আলাদা আলাদা করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দৌড়াদৌড়ি এবং ধাক্কা-ধাক্কি করবেন না। তবে ছেলেদের এমন নিয়ম নেই। রিয়াজুল জান্নাহ দোয়া কবুলের জায়গা। শুধু সবুজ কার্পেট বিছানো অংশটুকু রিয়াজুল জান্নাহ।
১৯. আপনার লাগেজের গায়ে বাংলাদেশের পতাকার ছাপ লাগাতে হবে এবং লাগেজের গায়ে বাংলা, ইংরেজি ও আরবিতে বাংলাদেশ লিখতে হবে। তাছাড়া নিজের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, মোয়াল্লেম নম্বর লিখতে হবে। দড়ি, টেপ, মার্কার পেন, কাঁচি, সুঁই-সুতা সঙ্গে রাখবেন।
২০. আপনি মক্কা বা মদিনা যেখনেই থাকুন না কেন, সেখানে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখবেন। কোনো কারণে আপনার সঙ্গী বা আপনি হারিয়ে গেলে সেই জায়গায় চলে আসবেন। সঙ্গীদের ফোন নম্বর সঙ্গে রাখবেন। আপনি নিজে হারিয়ে গেলে সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশ হজ ক্যাম্পে জানান। তারাই আপনাকে আপনার হোটেলে পৌঁছে দেবে।
২১. ফরজ তাওয়াফের সময় প্রচণ্ড ভিড় হয়। সাফা-মারওয়ায় ফরজ তাওয়াফ দোতালায় করলে ভিড় একটু কম পাওয়া যায়। কারণ সবাই চায় নিচে তাওয়াফ করতে। ফরজ তাওয়াফের পর সাঈ করার সময় অনেক ভিড় হবে। তবে চার তলায় একটা সাঈ করার জায়গা আছে। সেখানে ভিড় কম হয়। জায়গাটা আগে থেকে দেখে রাখবেন। কারণ জায়গাটার সিঁড়ি পেতে কষ্ট হয়।
আরও পড়ুনঃ
❒ পরীক্ষায় ভালো করার দোয়া ও আমল
❒ সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়ার ফজিলত
❒ শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচবেন উপায়
❒ ওমরা পালনের সর্বোত্তম সময় কোনটি
❒ মহানবী (সা.)-এর কথাবার্তার ১০টি অনন্য সৌন্দর্য
❒ উমরাহ পালনের ধারাবাহিক নিয়ম ও দোয়া
২২. যেখানেই যাবেন চেষ্টা করবেন ২/৩ জন একসঙ্গে থাকতে, তাতে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আর হ্যাঁ, টাকা-পয়সা অবশ্যই সাবধানে রাখবেন। হজের প্রতিটি কাজ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করবেন যাতে সামান্য ভুলটুকুও না হয়। কোথাও কোনো ভুল হলে অবশ্যই দম (রক্ত বা কোরবানির মাধ্যমে কাফফারা) দিতে হবে। চেষ্টা করবেন মানুষের সৃষ্ট জটলা এড়িয়ে চলতে। মনে রাখবেন এখানে আসার পেছনে উদ্দেশ্য শুধু একটাই আর সেটা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে গুনাহ মাফ করানো।
আল্লাহ তাআলা সকল হজযাত্রীকে যাবতীয় ভুল-ভ্রান্তি থেকে দূরে রাখুন। সতর্ককতার সঙ্গে সুন্নাহ অনুযায়ী হজের সকল কার্যক্রম যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
❑ ইসলামী জীবন থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ এক সফরে একাধিক ওমরা নাকি বারবার তাওয়াফ করা উত্তম?