আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: পড়া মনে রাখার সহজ ১৫টি বৈজ্ঞানিক কৌশল । রাতদিন বাবা মা বলেই যান, “বেশি করে পড়াশোনা কর! রেজাল্ট ভাল হতে হবে এবার!” আমরাও ভাল রেজাল্টের জন্য অথবা ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার আশায় বইয়ে মুখ গুঁজে ডুবে থাকি পড়াশোনায়। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এত পরিশ্রমের পরও ফলাফল মন মতো হচ্ছে না। অথচ পাশের বাড়ির ছেলেটাই সারাদিন খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকার পরও পরীক্ষায় অনেক ভালো রেজাল্ট করছে। এর কারণ কি শুধুই মেধার তারতম্য? কখনোই নয়! সৃষ্টিকর্তা সবাইকেই সমান মেধা দিয়ে পাঠিয়েছেন, কিন্তু সেই মেধার সঠিক ব্যবহার আর পড়াশোনা করার নিয়মই ক্লাসের ফার্স্ট বয় আর লাস্ট বয়ের ব্যবধান তৈরী করে।
দৈনন্দিন পড়াশোনা পদ্ধতিতে ছোট্ট ছোট্ট কিছু পরিবর্তন, জাদুকরী এক ভূমিকা রাখবে তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করার পেছনে। পড়াশোনায় মনোযোগ আনার উপায় হিসেবে সবাই কিছু না কিছু কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু কয়েকটি টিপস মেনে চললে তোমার প্রস্তুতিটি আরও সহজ ও পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাই আজকে থাকছে পড়াশোনায় মনোযোগ বসানোর কয়েকটি সহজ বৈজ্ঞানিক টিপস।
০১। একনাগাড়ে বেশিক্ষণ পড়াশোনা নয়
বিজ্ঞানীরা বলেন, মস্তিষ্কের তথ্য ধারণ ক্ষমতা টানা ২৫-৩০ মিনিট পরিশ্রমের পর হ্রাস পেতে শুরু করে। সুতরাং, একটানা ঘন্টার পর ঘন্টা বই নিয়ে পড়ে থাকার অভ্যাস বন্ধ করো। পড়ার সময়টুকুকে ছোট্ট ছোট্ট ভাগে আলাদা করে সাজিয়ে নাও।
প্রত্যেকটা ভাগ শেষ হওয়ার পর পাঁচ মিনিট ব্রেক নিবে। এই সময়টুকু একদম chill! তোমার যা করতে ভালো লাগে (কিছু খাওয়া, গান শোনা, ফেসবুকে একবার ঢুঁ মেরে আসা) এই সময়টুকুতে করবে, তারপর সতেজ মনে আবার পড়াশোনা করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
পড়ার সময় অবশ্যই সামনে খাতা কলম রাখো। যে জিনিসটা সহজে মনে থাকে না তা চট করে খাতায় লিখে ফেলো। কারণ পড়ার থেকে লেখার সময় তুলনামূলকভাবে বেশি মনোযোগের প্রয়োজন পড়ে। ফলে মস্তিষ্ক অন্য কোনো চিন্তা করার সুযোগ পায় না।
০২। মুখস্থ নয়, বুঝে পড়ো
ছোটবেলা থেকে আমাদের ছড়া, কবিতা ইত্যাদি দাঁড়িকমা সহ মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখতে লিখতে অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায় সবকিছু মুখস্থ করে ফেলার। এটি খুব ভুল একটি পদ্ধতি। অনেকেই আছে, যাদের কোন কিছুর সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে হুবুহু বই এর সংজ্ঞা গড়গড় করে বলে দিতে পারবে, কিন্তু ব্যাখ্যা করতে বললেই নিশ্চুপ!
Don’t just study hard, study ‘smart’
বর্তমান সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষায় এই মুখস্থবিদ্যা নির্ভরতা তোমাকে একদমই সাহায্য করবে না ভালো ফল করতে। সুতরাং বই এর সংজ্ঞা মুখস্থ করা বন্ধ করে মূল টপিকটা বুঝতে চেষ্টা করো। কেননা, মুখস্থ দশবার করলে দশবার ভুলবে, কিন্তু একবার ভালভাবে বুঝে নিতে পারলে কোনদিনও ভুলার চান্স নেই!
০৩। সুস্থ এবং শান্ত মন নিয়ে পড়তে বসা
আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন, যারা অসুস্থ অবস্থায় পড়তে বসেন। এতে পড়ার বদলে সময় নষ্ট হয়। পড়া মাথায় থাকে না। পড়া মনে রাখার উপায়, পড়তে বসার আগে অবশ্যই মনকে শান্ত এবং সুস্থ করতে হবে।
০৪। পড়তে বসার আগে হাটাহাটি করা
পড়ার টেবিলে বসার পূর্বে হালকা ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, পড়ার পূর্বে ১০ মিনিট হাঁটলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা প্রায় ১০ শতাংশ পরিমাণ বেড়ে যায়। পড়া মনে রাখার গোপন কৌশল হল পড়তে বসার আগে ব্যায়াম অথবা হাটাহাটি করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ মেধাবীরা যেসব কৌশল অবলম্বনে পড়াশোনা করেন
০৫। পড়াকে আকর্ষণীয় ভাবা
কোন বিষয় পড়ার আগে, সেই বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ তৈরী করতে হবে। আমরা সাধারণ জিনিসের চেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস বেশি মনে রাখতে পারি। তাই আকর্ষণ অনুভব করে পড়তে হবে।
০৬। রিভিশন করা
জার্মান মনোবিদ হারমান এবিনঘসের মতে, যে কোনো কিছু পড়ার এক ঘণ্টা পর সেটির মাত্র ৪৪ শতাংশ আমাদের মনে থাকে। অনেকে একটানা পড়তেই থাকে। এভাবে একটানা না পড়ে, বিরতি দিতে হবে। বিরতি দিয়ে, আগের পড়া জিনিসগুলো রিভিশন দিতে হবে। বিরতি দিয়ে রিভিশন করে পড়লে যে কোনো পড়াই অনেকদিন মনে থাকে।
০৭। হাইলাইট বা মার্ক করে পড়া
পড়া মনে রাখার গোপন কৌশল হল হাইলাইট বা মার্ক করে পড়া। অনেকেই বই দাগিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দাগিয়ে পড়তে হবে। দাগানো বা মার্ক করা শব্দগুলোর প্রতি আলাদা আকর্ষণ কাজ করে। তাই কয়েকবার পড়লেই এটা মনে থাকে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রঙের হাইলাইটার ব্যবহার করা যেতে পারে।
০৮। কাউকে শেখাও
আইনস্টাইন বলেন, “একটা বিষয় তোমার পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত হবে তখনই, যখন বিষয়টি তুমি কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবে।” পড়াশোনাকে যদি একটি গাড়ির সাথে তুলনা করো, তাহলে তুমি যখন একটি টপিক পড়লে, তখন সেটি হচ্ছে গাড়ির ইঞ্জিন। কিন্তু শুধু এটুকু দিয়েই তুমি কাউকে ঠিকভাবে বুঝাতে পারবে না টপিকটা। কেননা, কেবল ইঞ্জিন থাকলেই তো গাড়ি চলে না! গাড়ির অন্যান্য যন্ত্রাংশ – চেসিস, টায়ার ইত্যাদি সব মিলে যুক্ত হয়েই তৈরী হয় একটি গাড়ি।
যখন কাউকে একটি টপিক বুঝাতে যাবে, তখন লক্ষ্য করবে শুধু বইপড়া জ্ঞান দিয়ে কাজ হচ্ছে না। ঠিক গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের মতো, সবগুলো ঠিকমতো জোড়া দিলে তবেই চলবে গাড়ি, সেরকম তোমার টপিকটার বিভিন্ন আঙ্গিকের উপর সার্বিক একটা ধারণা থাকতে হবে, এবং সেটা গড়ে উঠবে কাউকে শেখাতে গেলেই, টপিকটার উপর তোমার জ্ঞান অনেক গভীরে পৌঁছাবে তখন।
০৯। নিবিড় মনোনিবেশ
একবার ভেবে দেখো তো, দিনে গড়ে কত ঘন্টা তুমি বইয়ের সামনে বসে কাটাও? এর মধ্যে কতটুকু সময় তোমার অখন্ড মনোযোগের সাথে পড়া হয়? খেয়াল করলে দেখবে, প্রচুর সময় হেলাফেলা করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। “জাস্ট ২ মিনিটের জন্য ফেসবুকে ঢুকবো!” “খেলার স্কোরটা দেখেই টিভি বন্ধ করে দিবো!” পড়তে বসলেই এমন অনেক ইচ্ছা কিলবিল করতে থাকে মাথার ভেতর। এই ইচ্ছাগুলো ঝেড়ে ফেলে দাও এখনই।
একই সাথে একাধিক কাজ করতে গেলে কোনটিই ভালোভাবে করা হয় না। যখন পড়তে বসবে, তখন সম্পুর্ণ মনোযোগ থাকবে বইয়ের পাতায়। মনোযোগ নষ্ট করার মতো যা কিছু আছে, সবকিছু দূরে সরিয়ে রাখবে এই সময়টুকুতে। অল্প সময় পড়বে, কিন্তু ১১০% মনোযোগের সাথে পড়বে। আর বিনোদনের জন্য স্টেপ ওয়ানে বলা পাঁচ মিনিটের ব্রেক তো আছেই!
১০। ছোট ছোট লক্ষ্য তৈরী করো
আমরা সবাই বছরের শুরুতে লক্ষ্য ঠিক করি, “এইবছর ফাটায়ে পড়াশোনা করবো!” এবং বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে সেটা “লক্ষ্য” হয়েই থেকে যায়, কার্যকরী আদৌ হয়ে উঠেনা! কেন এমনটি হয় কখনো ভেবে দেখেছো? আমরা ছোট থাকতে গুরুজনেরা আমাদের খাইয়ে পরিয়ে দিতেন, নিয়মিত পড়া আদায় করাতেন। এখন তুমি বড় হয়েছো, এখন আর কেউ প্রতিদিন তোমার পড়া ধরতে আসে না। তোমার সাফল্য ব্যর্থতার দায়ভার তোমার নিজের হাতেই।
প্রতিদিন ছোট ছোট লক্ষ্য ঠিক করো। “আমি এই টার্মে ফার্স্ট হতে চাই!” এত দীর্ঘমেয়াদী প্ল্যানে না গিয়ে “আমি আজকে ম্যাথ অমুক চ্যাপ্টার কমপ্লিট করবো” এরকম একদিনের প্ল্যান ঠিক করো। এবং সেটা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত হাল ছেড়ো না। প্রতিদিন এরকম ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণ করতে করতে বছরের শেষে গিয়ে দেখবে সত্যিই বছরজুড়ে ফাটাফাটি পড়াশোনা হয়েছে!
১১। পড়াশোনা হোক গল্পের, আনন্দের!
তুমি একদিন বাসে উঠে তোমার বন্ধুকে বললে, “এই জানিস! গতকাল কলেজের সামনে রাস্তায় কি কাহিনী ঘটেছে!” আমি বাজি ধরে বলতে পারি, বাসের সবাই সাথেসাথে কান খাড়া করে ফেলবে “কি কাহিনী ঘটেছে” সেটা শোনার জন্য! কারণটা খুব সোজা, আমরা সবাই গল্প শুনতে ভীষণ ভালবাসি! পড়াশোনাকে যখন সংজ্ঞা/ফর্মুলার নীরস জায়গা থেকে গল্পের ছাঁচে ফেলতে পারবে, দেখবে জিনিসটা আসলে কত মজার! গণিতের “x=?” এর সমাধান যেন গোয়েন্দা কাহিনীর “কে সেই কালপ্রিট?” বের করার মতোই! “ব্রেকিং ব্যাড” এর কল্যাণে রসায়নের ফর্মূলাগুলো তো এখন সবাই আগ্রহ নিয়েই শিখে!
১২। রিডিং পড়ার সময় মাঝে মাঝে দৃষ্টি সরাও
মানুষ তার সাবকনশ্যাস মাইন্ড বা অবচেতন মনে কিছু কিছু কাজ করতে পারে। যেমন ধরো তুমি শব্দ করেই অনর্গল রিডিং পড়ে যাচ্ছো অথচ তোমার মস্তিষ্কে সেগুলো পৌঁছাচ্ছে না, তুমি একইসাথে অন্য কোনোকিছু চিন্তা করছো।
এজন্য রিডিং পড়ার সময় প্রায়ই দৃষ্টি বইয়ের পাতা থেকে এক মুহূর্তের জন্য সরাবে। যে বাক্যটা এইমাত্র পড়লে বা বুঝলে সাথে সাথে তা না দেখে বলবে। তাহলে ঐ অবচেতন মনে রিডিং পড়া হবে না, অন্য চিন্তাও মাথায় আসার সুযোগই পাবে না।
১৩। পড়া জিনিসকে বাস্তবে মিল খোঁজা বা কল্পনা করা
আমরা আমাদের চারপাশে চলমান ঘটনা সহজেই মনে রাখতে পারি। তাই কোন বিষয় পড়ার সময়, সেই বিষয়কে বাস্তবে মিল বা উদাহরণ হিসেবে ভাবতে হবে।
১৪। জানার কৌতূহল নিয়ে পড়া
জানার কৌতূহল নিয়ে পড়তে হবে। তুমি যখন গল্পের বই পড়া তখন তাতে এতোই মগ্ন থাকো যে অনেক সময় ডাকলেও শুনো না। কেন জানো? কারণ তুমি গল্পের বই পড়ো কৌতূহল নিয়ে, এরপর ঘটনা কোনদিকে যাবে সেটা জানার কৌতূহল তোমার মধ্যে সর্বক্ষণ কাজ করতে থাকে। ফলে তুমি তাতে ডুবে থাকো। ঠিক একইভাবে পড়ার সময় যদি বিষয়টি জানার প্রবল কৌতূহল নিয়ে পড়ো তাহলে অন্য কোনো চিন্তা তোমার মাথায় আসবে না।
১৫। পরিমিত মাত্রায় ঘুম
যুক্তরাষ্ট্রের নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী জেসিকা পেইন এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মী মিলে একটি গবেষণা করেছেন। তাতে বলা হয়, পড়াশোনা শেষ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুমালে তা পড়া মনে রাখায় বেশ সহায়তা করে। তাছাড়া পরিমিত মাত্রায় ঘুমালে, মন এবং শরীর দুটোই ফ্রেশ থাকে। তাই পড়াশোনার পর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে হবে। সাধারণত একজন সুস্থ ব্যক্তির দিনে ৮ ঘন্টার মত ঘুমানো উচিত। এর থেকে কম ঘুমালে পড়া মনে রাখার সক্ষমতা হ্রাস পায়।
আরও পড়ুনঃ মানসিক রোগ কী?