আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: নোবেল পুরস্কার । ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত হওয়া একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যা ঐ বছর থেকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল ও অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন বা মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। মোট ছয়টি বিষয়ে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হলো: পদার্থবিজ্ঞান, ফিন্যান্স, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তি। নোবেল পুরস্কারকে এ সব ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদেরকে ইংরেজিতে নোবেল লরিয়েট বলা হয়।
সুয়েডীয় বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে এই পুরস্কার প্রচলন করা হয়। নোবেল মৃত্যুর পূর্বে উইলের মাধ্যমে এই পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে যান এবং শুধুমাত্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় নরওয়ের অসলোতে। বাকিসব ক্ষেত্রে সুইডেনের স্টকহোমে এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে, কিন্তু অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে। আলফ্রেড নোবেল তার উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। প্রতি বছর পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেকে একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ এবং নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক কিছু পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। ২০১২ সালে এ অর্থের পরিমাণ ছিল ৮০ লক্ষ সুইডিশ ক্রোনা এবং নোবেল পুরস্কার মৃত কাউকে দেয়া হয়না। লরিয়েটকে অবশ্যই পুরস্কার প্রদানের সময় জীবিত থাকতে হবে। কিন্তু এর কিছু ব্যতিক্রম আছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মরণোত্তর পুরস্কারও দেয়া হয়।
ইতিহাস
আলফ্রেড নোবেল ২১ অক্টোবর ১৮৩৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে একটি প্রকৌশল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও একজন উদ্ভাবক ছিলেন। ১৮৯৪ সালে তিনি একটি বফর লোহা ও ইস্পাত কারখানা ক্রয় করেন, যা পরবর্তীতে একটি অন্যতম অস্ত্র তৈরির কারখানায় পরিণত করেন। তিনি ব্যালিস্টিক উদ্ভাবন করেন, যা সারা বিশ্বব্যাপী ধোঁয়াবিহীন সামরিক বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তার ৩৫৫ টি উদ্ভাবনের মাধ্যমে তিনি জীবদ্দশায় প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ডিনামাইট।
১৮৮৮ সালে তিনি মৃতদের তালিকা দেখে বিস্মত হন, যা একটি ফরাসি পত্রিকায় এ মার্চেন্ট অব ডেথ হু ডেড প্রকাশিত হয়। যেহেতু নোবেলের ভাই লুডভিগ মারা যায়, এই নিবন্ধটি তাকে ভাবিয়ে তোলে এবং খুব সহজেই বুঝতে পারেন যে ইতিহাসে তিনি কীভাবে স্মরণীয় হতে চান। যা তাকে তার উইলটি পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত করে। ১০ ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে আলফ্রেদ নোবেল তার নিজ গ্রাম স্যান রিমো, ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
নোবেল তার জীবদ্দশায় অনেকগুলো উইল লিখে গিয়েছিলেন। সর্বশেষটা লেখা হয়েছিল তার মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে ২৭ নভেম্বর ১৮৯৫ সালে প্যারিসে অবস্থিত সুইডিশ-নরওয়ে ক্লাবে। বিস্ময় ছড়িয়ে দিতে, নোবেল তার সর্বশেষ উইলে উল্লেখ করেন যে, তার সকল সম্পদ পুরস্কার আকারে দেয়া হবে যারা পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্যে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে কাজ করবেন। তিনি তার মোট সম্পদের (৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা) ৯৪ শতাংশ এই পাঁচটি পুরস্কারের জন্য উইল করেন। ২৬ এপ্রিল ১৮৯৭-র আগ পর্যন্ত সন্দেহ প্রবণতার জন্য নরওয়ে থেকে এই উইল অনুমোদন করা হয় নি। তার উইলের সমন্বয়কারী রগনার সোলম্যান ও রুডলফ লিলজেকুইস্ট নোবেল ফাউন্ডেশন তৈরি করেন। যার কাজ তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।
১৮৯৭ সালে নোবেলের উইল অনুমোদন হবার সাথে সাথেই নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি নামক একটি সংস্থা তৈরি করা হয়। অতি শীঘ্রই নোবেল পুরস্কার দেবার অন্যান্য সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে ৭ জুন ক্যারোলিংস্কা ইনিস্টিটিউট, ৯ জুন সুইডিশ একাডেমি এবং ১১ জুন রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমি। নোবেল ফাউন্ডেশন কীভাবে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, তার একটি নীতিমালায় পৌছায় এবং ১৯০০ সালে নোবেল ফাউন্ডেশন নতুনভাবে একটি বিধি তৈরি করে যা রাজা অস্কার কর্তৃক জারি হয়। ১৯০৫ সালে সুইডেন ও নরওয়ের মধ্যে বন্ধন বিলুপ্ত হয়। তারপর থেকে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি শুধু মাত্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এবং সুইডেনের প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য পুরস্কারগুলো প্রদানের দায়িত্ব পায়
আলফ্রেড নোবেলের উইল
সুইডেনের রসায়নবিদ ও শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন, যার মাধ্যমে তার প্রচুর আয় হয়, আর এই আয়ের অর্থ দ্বারাই তিনি পুরস্কার প্রদানের কথা বলে যান। জীবদ্দশায় নোবেল অনেকগুলো উইল লিখেছিলেন, এর মধ্যে সর্বশেষটি লিখেন তার মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে নভেম্বর ২৭, ১৮৯৫ তারিখে। নোবেলের উদ্ভাবনটি ছিল অনেকাংশেই একটি বিস্ফোরক যা প্রভূত ক্ষতির কারণ হতে পারত। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে এই ডিনামাইটের ব্যবহার তাকে শঙ্কিত করে তোলে। নোবেল পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার দেয়ার জন্য তার মোট সম্পত্তির শতকরা ৯৪ ভাগ দান করে যান। এর মোট পরিমাণ ৩১ মিলিয়ন এসইকে (৩.৪ মিলিয়ন ইউরো, ৪.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
“The whole of my remaining realizable estate shall be dealt with in the following way:
The capital shall be invested by my executors in safe securities and shall constitute a fund, the interest on which shall be annually distributed in the form of prizes to those who, during the preceding year, shall have conferred the greatest benefit on mankind. The said interest shall be divided into five equal parts, which shall be apportioned as follows: one part to the person who shall have made the most important discovery or invention within the field of physics; one part to the person who shall have made the most important chemical discovery or improvement; one part to the person who shall have made the most important discovery within the domain of physiology or medicine; one part to the person who shall have produced in the field of literature the most outstanding work of an idealistic tendency; and one part to the person who shall have done the most or the best work for fraternity among nations, for the abolition or reduction of standing armies and for the holding and promotion of peace congresses.
The prizes for physics and chemistry shall be awarded by the Swedish Academy of Sciences; that for physiological or medical works by the Caroline Institute in Stockholm; that for literature by the Academy in Stockholm; and that for champions of peace by a committee of five persons to be elected by the Norwegian Storting. It is my express wish that in awarding the prizes no consideration whatever shall be given to the nationality of the candidates, so that the most worthy shall receive the prize, whether he be Scandinavian or not.”
যদিও আলফ্রেড নোবেল এই পুরস্কারের প্রচলন করেছেন, তথাপি তিনি এর কার্যক্রম দেখে যেতে পারেননি। কারণ তার পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ ছিল না। এছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু কারণে নোবেল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠায় কিছুটা দেরি হয়। প্রথম নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় ১৯০১ সালের ডিসেম্বর ১০ তারিখে।
প্রথম পুরস্কার
যখন নোবেল ফাউন্ডেশন ও তার নীতিমালাগুলো চূড়ান্ত হলো, তখন থেকেই নোবেল কমিটি প্রথম পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন সংগ্রহ করা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা প্রাথমিক নির্বাচিত প্রার্থীদের একটি তালিকাও পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে দেয়। প্রকৃতপক্ষে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি জরজেন লভল্যান্ড, জর্ন স্টার্ন জর্নসন এবং জোহানিজ স্টিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রদানের জন্য নিয়োগ দেয়। সেই কমিটি বিখ্যাত দুই জনকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করে, যারা ১৯ শতকের শেষের দিকে শান্তি আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। তারা ছিলেন আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফেদ্রিক পাসি ও রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা অঁরি দ্যুনঁ । ১৯০১ সালে প্রথম নোবেল বিজয়ীদের তালিকা :
পদার্থবিজ্ঞান | রসায়ন | চিকিৎসা | সাহিত্য | শান্তি | |
ভিলহেল্ম রন্টগেন | ফান্ট হফ | এমিলি ভন বেরিং | স্যুলি প্র্যুদম | অঁরি দ্যুনঁ | ফ্রেদেরিক পাসি |
নোবেল কমিটির পদার্থের পুরস্কারের জন্য মনোনীতের তালিকায় ছিলেন এক্স রশ্মি আবিষ্কারের জন্য ভিলহেল্ম কনরাড রন্টগেন এবং ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে কাজ করার জন্য ফিলিপ লেনার্ড। পরে বিজ্ঞান একাডেমি রন্টগেনকে নির্বাচিত করে। ১৯ শতকের শেষ দশকে অনেক রসায়নবিদ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তাই রসায়নে পুরস্কার দেবার ক্ষেত্রে একাডেমি এতজন বিজ্ঞানীর মধ্যে কাকে পুরস্কৃত করা যায় তা নিয়ে সামান্য সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। একাডেমি ২০টি মনোনয়ন পায়। তার মধ্যে ১১টিকেই ছিল ফান্ট হফের নাম।[২৩] রাসায়নিক তাপগতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হন।
সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে কবি সূলি প্রুধমকে। লেখক, কবি ও সাহিত্য সমালোচকদের ৪২ জনের একটি দল এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে যারা এর জন্য লিও টলস্তয়কে প্রত্যাশা করছিল। বার্টন ফেল্ডম্যানের মতো অনেকেই এই পুরস্কারের সমালোচনা করেছিল কারণ তারা প্রুধমকে মধ্যমসারির কবি মনে করত। ফেল্ডম্যানের ব্যাখ্যানুযায়ী, একাডেমির অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যের ভক্ত। তাই তারা সেরকম একজন কবিকেই বেছে নিয়েছেন। চিকিসায় প্রথম নোবেল পুরস্কার পান জার্মান চিকিৎসক ও অনুপ্রাণবিজ্ঞানী এমিলি ভন বেরিংকে। ১৮৯০ এর দশকে তিনি ডিপথেরিয়া প্রতিরোধক তৈরি করেন, যা আজ পর্যন্ত প্রতি বছর হাজার লোকের জীবন রক্ষা করে চলছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে এডলফ হিটলার জার্মানির তিন জন পুরস্কারপ্রাপ্তকে (রিচার্ড কুন, গার্হার্ড ডোমাগ ও এডলফ ফ্রেদরিক জোহান বুতেন্ড) তাদের পুরস্কার নেয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন। পরবর্তীতে তাদের সকলেই পদক ও সনদ গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। যদিও সুইডেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিল, তারপরও সে সময় নোবেল পুরস্কার অনিয়মিতভাবে দেয়া হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। নরওয়ের উপর জার্মানির অন্যায্য অধিকারের জন্য এই ক্ষেত্রে ১৯৪০-৪২ সাল পর্যন্ত কোনো পুরস্কার প্রদান করা হয় নি। এই বছরগুলোতে সাহিত্য ও শান্তি ছাড়া বাকি সব বিষয়গুলোতে পুরস্কার প্রদান করা হয়।
নরওয়ে দখল থাকা অবস্থায়, নরওয়েজীয় নোবেল কমিটির তিনজন সদস্যকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। বাকি সদস্য এই নির্যাতন থেকে তখনই মুক্তি পায় যখন নোবেল ফাউন্ডেশন এই বিবৃতি দেয় যে, অসলোতে গঠনকৃত কমিটি সুইডেনের আওতাধীন। সেই সকল সদস্যরা কমিটির কার্যক্রম সচল রেখেছিল যদিও কোনো পুরস্কার প্রদান করা হয় নি। ১৯৪৪ সালে নোবেল ফাউন্ডেশন তিন নির্বাসিত সদস্যসহ নিশ্চিত করে যে, পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন নেয়া হয়েছিল এবং আবারও পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে।
অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান
১৯৬৮ সালে সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ৩০০ বছর পূর্তিতে নোবেল ফাউন্ডেশনকে একটি বিরাট অঙ্কের অর্থ দান করে। যা নোবেলের সম্মান রক্ষার্থে একটি নতুন পুরস্কার প্রদান করার কাজে ব্যবহৃত হবে। তার ঠিক পরের বছরে অর্থনীতিতে প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। অর্থনীতিতে পুরস্কার মনোনীত করার দায়িত্ব পড়ে রাজকীয় সুয়েডীয় বিজ্ঞান একাডেমির ওপর।
জান টিনবার্গেন ও রাঙ্গার ফ্রিস হল অর্থনীতিতে প্রথম নোবেল বিজয়ী। অর্থনৈতিক পদ্ধতিসমূহে তাদের গতি তত্ত্ব প্রয়োগ করা ও উন্নতি করার জন্য তাদের এই সম্মানে ভূষিত করা হয়। যদিও নোবেল পুরস্কার নয়, তথাপি অন্যান্য পুরস্কারের সাথে এটি শনাক্ত করা হয় এবং সুইডিশ নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অন্যান্য পুরস্কার প্রাপ্তদের সাথে তাদের নাম ঘোষণা করা হয়।
পুরস্কৃত হবার পদ্ধতি
অন্যান্য পুরস্কারের তুলনায় নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন ও নির্বাচন পদ্ধতি বেশ দীর্ঘ এবং কঠোর। এই কারণেই নোবেল পুরস্কার পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারের মর্যাদা পেয়েছে।
মনোনয়ন
নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট মনোনয়নপত্র রয়েছে। সমগ্র বিশ্ব থেকে নির্বাচিত ৩০০০ জনকে এই মনোনয়নপত্র দেয়া হয় যাতে তারা তা পূরণ করে পুরস্কারের আবেদন করতে পারে। নোবেল শান্তি পুরস্কার নির্বাচনের জন্য এমন সব ব্যক্তিদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয় যারা এ বিষয়ে বিশেষ কর্তৃত্বের দাবীদার। যে বছর পুরস্কার প্রদান করা হবে তার ৩১ শে জানুয়ারী মনোনয়ন পত্র প্রদানের শেষ তারিখ। নোবেল কমিটি তাদের মধ্যে সম্ভাব্য ৩০০ জনকে মনোনীত করে। মনোনীতদের নাম প্রকাশ করা হয় না এমনকি তাদেরকে জানানোও হয় না যে তারা মনোনীত হয়েছেন। মনোনয়নের এসব নথি পুরস্কার প্রদান থেকে ৫০ বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
নির্বাচন
তারপর নোবেল কমিটি সম্পর্কিত বিষয়সমূহের বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃত প্রার্থীদের তালিকাসহ এই প্রতিবেদনটি নোবেল পুরস্কার প্রদানের সংস্থাগুলোকে পাঠানো হয়। সংস্থাগুলোকে আধিক্য ভোটের মাধ্যমে প্রত্যেকটি বিষয়ে বিজয়ী নির্বাচিত করতে হয়। ভোটের ঠিক পরপরই তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়। একটি পুরস্কার সর্বোচ্চ তিনজন এবং দুটি ভিন্ন কাজের জন্য দেয়া যায়। নোবেল শান্তি পুরস্কার যে কোন সংস্থাকে প্রদান করা যায় তাছাড়া সকল পুরস্কার শুধু মাত্র জীবন্ত ব্যক্তিকে দেয়া হয়ে থাকে। যদি শান্তি পুরস্কার দেয়া না হয় তবে তার অর্থ বিজ্ঞানের অন্যান্য পুরস্কারে সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। যা এযাবতকালে ১৯ বার ঘটেছে।
মরণোত্তর পুরস্কার
যদিও মৃত্যু পরবর্তী মনোনয়ন অনুমোদিত নয়, তথাপিও যদি প্রার্থীর মৃত্যু মনোনয়ন প্রদান ও নোবেল কমিটির পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে হলে তবে তা নির্বাচিত হবার যোগ্য হবে। ইতিহাসে এমনটি দুইবার ঘটেছে: ১৯৩১ সালে সাহিত্যে এরিক এক্সেল কার্লফেল্ড এবং ১৯৬১ সালে শান্তিতে জাতিসংঘের মহাসচিব ড্যাগ হেমার্শেল্ড। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এমনটি ভাবা হত যে অক্টোবরের ঘোষণা পর্যন্ত বিজয়ী বেঁচে থাকবেন। উইলিয়াম ভিক্রী নামক একজন নোবেল বিজয়ী ১৯৯৬ সালে পুরস্কার (অর্থনীতিতে) ঘোষণার পর কিন্তু প্রদানের আগে মারা যান। ৩ অক্টোবর ২০১১ চিকিৎসায় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়; তদ্যাবধি কমিটি জানতো না যে বিজয়ীদের একজন রালফ স্টেইনম্যান তিন দিন আগে মারা গেছেন। কমিটিতে রালফ স্টেইনম্যানের পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক চলছিল কারণ মরণোত্তর পুরস্কার নিয়মের পরিপন্থী। পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত অক্ষুণ্ন রাখার হয়।
পুরস্কারের ক্ষেত্রসমূহ
পুরস্কার প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা
পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে যে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োজিত তারা সবাই ঠিক অক্টোবর মাসে লরিয়েটদের নাম ঘোষণা করে। ঘোষণার পর ১০ ডিসেম্বর তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক প্রদান করা হয়। এই দিনটি আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকী।
নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান পূর্বে নরওয়েজীয় নোবেল সমিতি (১৯০৫ – ১৯৪৬) এবং অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আউলা-তে (অডিটোরিয়াম) (১৯৪৭ – ১৯৯০) অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে অসলো সিটি হলে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছাড়া অন্য পুরস্কারগুলো প্রদান করা হয় স্টকহোম কনসার্ট হলে।
প্রতি বছর একই বিষয়ে সর্বোচ্চ তিনজনকে পুরস্কার দেয়া যায়। এই লরিয়েটদের প্রত্যেককে দেয়া হয়; একটি স্বর্ণপদক, একটি ডিপ্লোমা, সুইডেনের নাগরিকত্ব এবং একটি মোটা অঙ্কের অর্থ। বর্তমানে এই অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১০ মিলিয়ন সুয়েডীয ক্রোনার (১ মিলিয়ন ইউরোর সামান্য বেশি/ ১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই অর্থ প্রদানের মূল কারণ এই যে, লরিয়েটরা যেন পুরস্কার পাবার পর তাদের আরো উচ্চতর গবেষণা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যে সময় নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় সে সময় দেখা যায় অধিকাংশ লরিয়েটই অবসর জীবন যাপন করছেন।
১৯০২ সাল থেকে সুইডেনের রাজা স্টকহোমে পুরস্কার বিতরণ করে আসছেন। প্রথম বছর সুইডেনের রাজা ছিলেন রাজা ২য়অস্কার; তিনি এতো মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার বিরোধী ছিলেন। এজন্য তিনি পু্রষ্কার প্রদানে সম্মত হননি। পরবর্তীতে অবশ্য জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্য এবং সুইডেনের সম্মান রক্ষার খাতিরেই তাকে মত পরিবর্তন করতে হয়েছে।
১৯০৪ সালে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি গঠিত হয়। এর আগে নরওয়ের রাষ্ট্রপতি নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার দায়িত্ব পালন করতেন। গঠনের পর কমিটির ৫ জন সদস্য শান্তি পুরস্কার দেবার জন্য গবেষণামূলক কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করে। তাদেরকে নরওয়েজীয় আইনসভা মনোনয়ন দেয়, তথাপি তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। নরওয়ের আইনসভার সদস্যরা এই কমিটিতে অংশ নিতে পারেন না।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া
আরও পড়ুন: প্রবীণদের পুষ্টি চাহিদা