আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: থ্যালাসেমিয়া কী ও কেন হয় ? থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। রক্তের ক্যানসারও নয়। এটি কেন হয় এবং হলে করণীয় কী এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ
রোগীর ব্লাড নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে বা ক্লিনিক্যালি থ্যালাসেমিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন-থ্যালাসেমিয়া মেজর (অতিমাত্রা), মাইনর (অল্প মাত্রা) এবং ইন্টারমিডিয়েট (মধ্যম মাত্রা)। থ্যালাসেমিয়া অনেক ধরনের যেমন-বিটা থ্যালাসেমিয়া, ই বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন ই ডিজিজ, আলফা থ্যালাসেমিয়া, এস বিটা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিন এস ডিজিজ, হিমোগ্লোবিন ডি পাঞ্জাব, হিমোগ্লোবিন ডি আরব ইত্যাদি।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয়
বাবা ও মা দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জেনেটিক কারণে কি থ্যালাসেমিয়া হয়
মানবদেহে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। এ প্রতি জোড়ার অর্ধেক মায়ের আর বাকি অর্ধেক বাবার থেকে আসে। ১৬নং ক্রোমোজোমে থাকে আলফা জিন আর ১১নং ক্রোমোজোমে থাকে বিটা জিন। আলফা ও বিটা জিনদ্বয় আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন তৈরি করে যা অনেক এমাইনো অ্যাসিডের সমষ্টি। জন্মগতভাবে ১৬ বা ১১নং ক্রোমোজোমের আলফা অথবা বিটা জিন সঠিকভাবে এমাইনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে না। ফলে আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন ত্রুটিপূর্ণ হয়। আলফা বা বিটা গ্লোবিন চেইন ত্রুটিপূর্ণ থাকায় লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন ত্রুটিপূর্ণ হয় বলে লোহিত রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যায় এবং রক্তস্বল্পতা ও জন্ডিস দেখা দেয়। মানবদেহে যেহেতু জোড়ায় জোড়ায় জিন থাকে তাই একটা জিন ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া বাহক/মাইনর/ট্রেইট/হেটারোজাইগোস স্টেট অব থ্যালাসেমিয়া বলে। আর দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া মেজর বা রোগী বা হোমোজাইগোস স্টেট অব থ্যালাসেমিয়া বলে। থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর থ্যালাসেমিয়ার রোগী এক কথা নয়।
আরও পড়ুনঃ কোন রোগে কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাবেন?
থ্যালাসেমিয়ায় কেন রক্তস্বল্পতা থাকে
লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিন (হিম+গ্লোবিন) থাকে বিধায় রক্ত লাল দেখায়। স্বাভাবিক মানুষের লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও থ্যালাসেমিয়া রোগীর ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারণে লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু মাত্র ২০ থেকে ৬০ দিন। অপরিপক্ব অবস্থায় লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যায়, তাই রক্তস্বল্পতা ও জন্ডিস দেখা দেয়।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ
থ্যালাসেমিয়ার বাহক স্বাভাবিক মানুষরূপে বেড়ে ওঠে। তাই কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, তা বাহ্যিকভাবে বোঝার কোনো উপায় নেই। আর থ্যালাসেমিয়ার রোগী জন্মের ৬ মাস বয়স থেকে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, জন্ডিস দেখা দেয়। পেটের প্লীহা ও লিভার বড় হয়ে যায়। ঠিকমতো শরীরের বৃদ্ধি হয় না।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা
রক্তস্বল্পতার জন্য প্রতি মাসেই রক্ত নিতে হয়। ঘনঘন রক্ত নেওয়ায় ও পরিপাক নালি থেকে আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিভার, হৃৎপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গের নানা রকম মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত রক্ত না নিলে থ্যালাসেমিয়া রোগী মারা যায়। প্রতিবার রক্ত নেওয়া ও আয়রন কমানোর ওষুধসহ অন্যান্য খরচে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসায় প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। নিয়মিত রক্ত দিয়ে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিক চিকিৎসা করালে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হলেও সঠিক চিকিৎসা বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
খাদ্য উপদেশ
থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর রোগীর খাবারের উপদেশ এক নয়। বাহকের খাবার স্বাভাবিক মানুষের মতো। আয়রন জাতীয় খাবারের নিষেধ নেই বরং আয়রনের ঘাটতি হলে বেশি বেশি আয়রন জাতীয় খাবার খেতে দিতে হয়। আর থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য আয়রন জাতীয় খাবার কম খেতে হয় এবং প্রয়োজনে শরীর থেকে আয়রন কমানোর ওষুধ দিতে হয় যা ব্যয়বহুল। তবে কোনো কারণে আয়রনের ঘাটতি থাকলে অবশ্যই আয়রন জাতীয় খাদ্য ও ওষুধ দিতে হবে।
বাংলাদেশে সমস্যা কোথায়
থ্যালাসেমিয়া স্ক্রেনিং প্রোগ্রাম না থাকায় অনেকেই জানে না তিনি বাহক কি না। তাই অজান্তেই দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে হচ্ছে এবং দিন দিন থ্যালাসেমিয়া রোগী বাড়ছেই।
থ্যালাসেমিয়া বংশাণুক্রমে কীভাবে বাহক বা রোগী হয়
বাবা-মা উভয়েই বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ২৫ ভাগ, বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ ভাগ। বাবা-মা যে কোনো একজন বাহক হলে প্রতিটি সন্তান জন্মদানে থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ, সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা শতকরা ৫০ ভাগ, তবে রোগী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হলে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধে করণীয়
▶ যেহেতু মা-বাবা দু’জনের জিনেই বাহক থাকলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে না হওয়া বা বন্ধ করা। একজন সুস্থ মানুষ যে কাউকে (বাহক বা রোগীকে) বিয়ে করতে পারবে। কারণ তাদের সন্তান রোগী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে না করাই উত্তম। কারণ সন্তানের রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
▶ দুজন বাহকের মধ্যে যদি বিয়ে হয়েই যায় বা স্বামী স্ত্রী দু’জনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়, তবে বাচ্চা পেটে আসার আট থেকে চৌদ্দ সপ্তাহের মধ্যে ক্রওনিক ভিলাস স্যাম্পল বা এমনিওসেন্টেসিস করে বাচ্চার অবস্থা জানা যায়। পেটের বাচ্চা রোগী হলে কাউন্সিলিং করতে হবে যাতে একজন নতুন থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্ম না হয় (গর্ভপাত)। তবে থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে বাচ্চার স্বাভাবিক জন্মদানে অসুবিধা নেই। তাই বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেককে জানতে হবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা গেলেই থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কীভাবে জানা যাবে কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না
হেমাটোলজি অটো এনালাইজার মেশিনে রক্তের সিবিসি পরীক্ষায় থ্যালাসেমিয়া বাহকের ধারণা পাওয়া যায়। এরপর হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে, ক্ষেত্রবিশেষ ডিএনএ এনালাইসিস পরীক্ষা করা লাগে। বংশগত রোগগুলো চিকিৎসার চেয়ে সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই উত্তম।
থ্যালাসেমিয়ার উন্নত চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়া রোগী যাদেরকে অন্যের রক্তের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা ডোনারের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা এলোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট (বিএমটি)। জিনথেরাপির ব্যবহার এখনো সীমিত ও পরীক্ষাধীন।
বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সুবিধা ও অসুবিধা
▶ অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে এককালীন বেশি টাকার দরকার হলেও তা সারাজীবনের ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন চিকিৎসা ব্যয় থেকে অনেক কম।
▶ সঠিক রোগীদের বেলায় ৮৭-৯০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
▶ আমাদের দেশে ডোনার রেজিস্ট্রি না থাকায় উপযুক্ত ম্যাচিং বোনম্যারো ডোনার পাওয়া দুষ্কর।
▶ ট্রান্সপ্ল্যান্ট পরবর্তী জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি আছে।
▶ ট্রান্সপ্ল্যান্টের জটিলতা কমাতে ও ভালো ফলাফল পেতে হলে নিয়মিত সঠিকভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও ব্লাড ট্রান্সফিউশন শুরুর ১৮ মাসের মধ্যে আয়রন চিলেশন শুরু করে আয়রন নিয়ন্ত্রণ এবং লিভার স্বাভাবিক রাখা অপরিহার্য। কারণ দীর্ঘদিন অধিক আয়রনের উপস্থিতি দেহের অনেক অঙ্গ বিশেষ করে লিভার ও হার্টের ক্ষতি করে, যা পরে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।
কোন বয়সে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা উচিত
সুনির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা নেই, তবে দুই বছরের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। অনিয়মিতভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন থেরাপি যারা গ্রহণ করে থাকে তাদের বেলায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরিবর্তে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা যায়।
অস্থিমজ্জা কে ডোনেট করবে
ডোনার হওয়ার পূর্বশর্ত হলো এইচএলএ টিস্যু সম্পূর্ণ অথবা অর্ধেক বা হাফ ম্যাচিং যা মুখের লালা থেকে পরীক্ষা করে হয়ে থাকে। আপন ভাইবোন যাদের থ্যালাসেমিয়া মেজর বা হিমোগ্লোবিন-ই/বিটা থ্যালাসেমিয়া নেই, তাদের মধ্যে সম্পূর্ণ এইচএলএ ম্যাচ (১০/১০, ৮/৮ অথবা ৬/৬) আদর্শ ডোনার হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া বাহক (মাইনর) ডোনার হতে পারবেন। যাদের সম্পূর্ণ এইচএলএ ম্যাচ আপন ভাইবোন নেই সেক্ষেত্রে অর্ধেক ম্যাচ বা হ্যাপ্লো আইডেন্টিক্যাল ডোনার হিসাবে আপন ভাইবোন অথবা বাবা-মাকেও নির্বাচন করা যায় অথবা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক বোনম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি থেকে অনাত্মীয়ের সম্পূর্ণ এইচএলএ ম্যাচ ডোনার নির্বাচন করা হয়। তবে ম্যাচজড অনাত্মীয় ডোনারের চেয়ে ম্যাচজড ভাইবোন ডোনার ভালো।
কীভাবে অনাত্মীয় ম্যাচ ডোনার পাওয়া যায়
ব্লাড ব্যাংকে যেমন স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের ব্লাড গ্রুপিংয়ের তালিকা থাকে, তেমনি স্বেচ্ছায় যারা বোনম্যারো স্টেমসেল ডোনেট করতে চায় তাদের এইচএলএ টাইপিং জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে বোনম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রিতে লিপিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ‘বাংলাদেশ ম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি (BMDR)’ চালু হলেও এর কার্যক্রম খুবই সীমিত।
লেখক : রক্তরোগ মেডিসিন ও ব্লাড ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক (হেমাটোলজি), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল।
আরও পড়ুনঃ শীতকালে চোখের যত্ন