আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: টাইটানিয়াম কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন মাইলফলক । বিশ্বে প্রথমবারের মতো ১০০ দিনেরও বেশি সময় কৃত্রিম হৃদপিণ্ড নিয়ে বেঁচে ইতিহাস গড়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এক নাগরিক। যিনি টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি এই কৃত্রিম হৃদপিণ্ড স্থাপনের পর সুস্থভাবে জীবনযাপন করেছেন এবং সম্প্রতি সফলভাবে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেছেন।
নিউ সাউথ ওয়েলসের ৪০ বছর বয়সি এই ব্যক্তি মারাত্মক হার্ট ফেইলিওরের শিকার হন এবং চিকিৎসকদের পরামর্শে গত বছরের নভেম্বরে সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালের সার্জন পল জানজের নেতৃত্বে একটি ছয় ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাইভাকর (BiVACOR) নামক কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়।
অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘদিন জটিলতা ছাড়াই তিনি জীবনযাপন করেন এবং চলতি মাসের শুরুর দিকে একটি দাতা হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন সফলভাবে সম্পন্ন হয়। চিকিৎসকরা এই উদ্ভাবনকে একটি অবিস্মরণীয় ক্লিনিক্যাল সাফল্য হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বাইভাকর কী?
কুইন্সল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী ড. ড্যানিয়েল টিমসের উদ্ভাবিত বাইভাকর (BiVACOR) একটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম হৃদপিণ্ড যা রোগীদের দাতা হৃদপিণ্ড পাওয়া পর্যন্ত জীবিত রাখার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি একটি ক্রমাগত রক্ত পাম্প করার যন্ত্র, যেখানে একটি চৌম্বকীয়ভাবে ভাসমান রোটর রক্ত সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করে।
যন্ত্রটি শরীরের অভ্যন্তরে প্রতিস্থাপন করা হলেও এটি একটি বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, যা ব্যাটারির মাধ্যমে চালিত হয় এবং রাতে বৈদ্যুতিক সংযোগে প্লাগ ইন করা যায়। টাইটানিয়াম ব্যবহারের ফলে এটি অধিক জীবাণুমুক্ত, ক্ষয়রোধী এবং টেকসই।
স্থায়ী বিকল্প হতে পারে কৃত্রিম হৃদপিণ্ড?
অন্যান্য কৃত্রিম হৃদপিণ্ডের তুলনায়, বাইভাকরের মাত্র একটি চলমান অংশ রয়েছে, যা যান্ত্রিক সমস্যা ও ব্যর্থতার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। এটি আপাতত অস্থায়ী বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে কার্ডিওলজিস্টদের মতে, এটি ভবিষ্যতে যাদের জন্য হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়, যেমন—বয়স্ক বা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য স্থায়ী সমাধান হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা ও পরীক্ষা প্রয়োজন।
যদিও বাইভাকরের সফলতা আশাব্যঞ্জক, তবুও কৃত্রিম হৃদপিণ্ডের টিকে থাকার সময়সীমা এখনো দাতা হৃদপিণ্ডের তুলনায় অনেক কম। একজন রোগীর দাতা হৃদপিণ্ড সাধারণত ১০ বছর বা ৩,০০০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে, যেখানে কৃত্রিম হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা এখনো পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বে প্রথম মানব শরীরে ‘রোবোটিক হার্ট’ প্রতিস্থাপন সৌদিতে
‘বাইভাকর’ নামে পরিচিত এই যন্ত্রটি বিশ্বব্যাপী ছয়জনের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তবে এক মাসের বেশি সময় এটি নিয়ে বেঁচে থাকা ব্যক্তি তিনিই প্রথম।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টোরিয়ান হার্ট ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন জুলিয়ান স্মিথ বলেন, এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসকুলার সার্জন সারাহ আইটকেন বলেন, “এটি একটি অবিশ্বাস উদ্ভাবন।” তবে এই যন্ত্র ব্যবহারকারীদের কর্মক্ষমতার মাত্রা এবং এর চূড়ান্ত ব্যয়ের বিষয়ে এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, “এই ধরনের গবেষণা করা সত্যিই কঠিন, কারণ এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এতে জড়িত অস্ত্রোপচারও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।”
এই সাম্প্রতিক সাফল্য গবেষকদের বাস্তব পরিবেশে এই যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়া বোঝার সুযোগ করে দেবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের টেক্সাস হার্ট ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট এবং হার্ট ফেইলিওর বিশেষজ্ঞ কার্ডিওলজিস্ট জোসেফ রজার্স।
সব ক্ষেত্রেই, রোগীর জন্য একজন দাতা না পাওয়া জন্য বাইভাকর অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে কিছু কার্ডিওলজিস্ট মনে করেন, এটি ভবিষ্যতে এমন ব্যক্তিদের জন্য স্থায়ী বিকল্প হয়ে উঠতে পারে, যারা বয়স বা অন্যান্য স্বাস্থ্যগত কারণে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের জন্য উপযুক্ত নন। যদিও এই ধারণাটি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হার্ট ফেইলিওরের মতো সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু ২০২৩ সালে মাত্র ৪,৫০০টি হৃদ্যন্ত্র প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল, যার অন্যতম কারণ দাতার স্বল্পতা।
সাসপেন্ডেড রোটর: বাইভাকর উদ্ভাবন করেছেন বায়োমেডিক্যাল প্রকৌশলী ড্যানিয়েল টিমস। তিনি এই ডিভাইসের নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোম্পানিটির অফিস রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার হান্টিংটন বিচে এবং অস্ট্রেলিয়ার সাউথপোর্টে।
এই ডিভাইসটি একটি সম্পূর্ণ হৃদ্যন্ত্রের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। এটি নিরবিচ্ছিন্নভাবে পাম্প করে রক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করে। এতে ম্যাগনেটিকালি সাসপেন্ডেড রোটর ব্যবহার করা হয়েছে। এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে নিয়মিত পালসে রক্ত সরবরাহ করে।
আর এ ডিভাইসটিতে বাইরে থেকে একটি কর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এটি একটি পোর্টেবল কন্ট্রোলারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ কন্ট্রোলারটি দিনের বেলায় ব্যাটারিতে চলে এবং রাতে বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে চলে।
অনেক কৃত্রিম যান্ত্রিক হৃদ্যন্ত্রের ডিভাইস হৃৎপিণ্ডের বাম পাশে বসানো হয় এবং এর সঙ্গে একটি থলে যুক্ত থাকে যার মধ্যে রক্ত সংগ্রহ করে সারাদেহে রক্ত প্রবাহের কাজ করা হয়। এই থলেটি প্রতি বছর প্রায় ৩.৫ কোটি বার সংকুচিত হয় রক্ত পাম্প করার জন্য। তবে এই ডিভাইসগুলোর অনেক অংশ থাকে এবং সেগুলোতে প্রায়ই বিভিন্ন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়।
কিন্তু বাইভাকরে মাত্র একটিই অংশ রয়েছে। যার কারণে যান্ত্রিক ত্রুটিও কম দেখা দেয় বলে মনে করেন রজার্স।
যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা : বাইভাকর প্রতিস্থাপন করা অস্ট্রেলিয়ান ব্যক্তির দেহে গত নভেম্বরে ছয় ঘণ্টা অস্ত্রোপচার করে টাইটানিয়ামের তৈরি কৃত্রিম হৃদ্যন্ত্রটি প্রতিস্থাপন করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তিনি হাসপাতালের কাছেই একটি একটি বাসায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। মার্চে তিনি একজন দাতার হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রজার্সের নেতৃত্বে পরিচালিত পরীক্ষায়, গত বছর ৪০-৫০ বছর বয়সী পাঁচজন ব্যক্তি বাইভাকরের একটি পুরোনো সংস্করণ ব্যবহার করেন। এই ডিভাইস তাদের হাসপাতালের ভেতরে এক মাস পর্যন্ত সচল রাখে, তবে বাড়িতে ব্যবহারের জন্য এটি তৈরি করা হয়নি। পরবর্তীতে এই পাঁচজনই দাতা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। রজার্স আগামী এপ্রিল মাসে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এই পরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করার পরিকল্পনা করছেন।
আরও পড়ুনঃ
❒ ইমপ্লান্ট স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীকে আবার শ্বাস নিতে সাহায্য করল
❒ স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটাচ্ছে রোবট
❒ মানুষের মস্তিষ্কের কাজ করার গতি পরিমাপের দাবি বিজ্ঞানীদের
❒ স্টেম সেল প্রতিস্থাপনে ফিরে পাওয়া যাবে চোখের দৃষ্টি
এরপর থেকে বাইভাকর দল ডিভাইসটির কার্যকারিতা উন্নত করেছে এবং ব্যর্থতার ঝুঁকি কমিয়েছে বলে জানিয়েছেন টেক্সাস হার্ট ইনস্টিটিউটের হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ও বাইভাকরের প্রধান চিকিৎসাবিষয়ক কর্মকর্তা উইলিয়াম কোহেন।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) আরও ১৫ জন রোগীর ওপর পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছে। তবে সারাহ আইটকেন বলেন, এটি সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা পদ্ধতি হয়ে উঠতে এখনো বহু ধাপ বাকি।
এই চিকিৎসাব্যবস্থা ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে হৃদরোগীদের জন্য একটি নতুন আশার আলো হয়ে উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
❑ চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ মানুষের শরীরে বার্ধক্য ঠেকানোর নতুন কৌশল আবিষ্কার