আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: টাইটানিক জাহাজের অজানা কিছু রহস্য । ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল সমুদ্রে যাত্রা করে টাইটানিক। জাহাজের আকার এবং সুযোগ সুবিধার জন্য সেসময় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় ফেলে দেয় টাইটানিক। ঐশ্বর্যময় জাহাজটি ছিল বিস্ময়কর সৌন্দর্যের প্রতীক। জাহাজের মালিক থেকে শুরু করে যাত্রী- কেউ কখনো ভাবেননি, বিলাসবহুল এই বাহনের এমন পরিণতি হবে।
নামকরণ
টাইটান’ ছিল গ্রিক পুরানের শক্তিশালী দেবতা। তার নামানুসারে এই জাহাজের নাম রাখা হয়েছিল ‘টাইটানিক’। এটি আসলে জাহাজটির সংক্ষিপ্ত নাম। এর পুরো নাম ছিল ‘আর এম এস টাইটানিক’। ‘আর এম এস’ এর অর্থ হচ্ছে ‘রয়্যাল মেল স্টিমার’। অর্থাৎ পুরো জাহাজটির নাম ছিল ‘রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক’।
নির্মাণকালীন তথ্য
টাইটানিক জাহাজটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয় ১৯০৭ সালে। পাঁচ বছর একটানা কাজ করে ১৯১২ সালে জাহাজটির কাজ শেষ হয়। ইংল্যান্ডের ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ এই জাহাজটি নির্মাণ করেন। সেসময়ের সবচেয়ে বড় জাহাজ ছিল টাইটানিক। এটির লম্বায় প্রায় ৮৮৩ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং চওড়ায় প্রায় ৯৩ ফুট এবং ওজন ৬০,০০০ টন। জাহাজটি নির্মাণ করতে সে সময় খরচ হয়েছিল ৭৫ লাখ ডলার । বিশ্বকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ল্যান্ডমার্ক ছিল টাইটানিক। সেবছরের জন্য একপ্রকার জাদু ছিল টাইটানিক। আধুনিকতা ও সৌন্দর্য- সৌন্দর্য কিংবা আধুনিকতায় দু ক্ষেত্রেই টাইটানিক ছিল অতুলনীয়। টাইটানিকে সংযুক্ত ওয়্যালেস প্রযুক্তি ওই সময়ের বিশ্ময় ছিল।
সেই প্রযুক্তির মাধ্যমে দু’শত পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত বার্তা আদান প্রদান করা যেত। চোখ ধাঁধানো স্হাপত্যশৈলী, দেওয়ালে কাঠের ডিজাইন, ঝারবাতির আলক সজ্জা আর নজরকারা আসবাবপত্রের সমাহারের কারনে টাইটানিকের খ্যাতি আজো বিদ্যমান। ১১তলা জাহাজে ওঠানামা করার জন্য ছিল ৩টি লিফট। ৫০০ জন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ডাইনিং, জিমনেশিয়াম ও বিলাসবহুল প্রমোদ কক্ষের কথা ভাষায় বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন।
আরও পড়ুনঃ যেভাবে বুঝবেন আপনি অহংকারী
যাত্রা শুরু
১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে টাইটানিক। সে সময় টাইটানিকে মোট যাত্রী ছিল ২২০০ জন এবং কয়েকশ কর্মী। শুরুতেই মাত্র চার ফুটের জন্য ‘এসএসসিটি অব নিউইয়র্ক’ জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে সমর্থ হয়। ৭৭ নটিক্যাল মাইল এগিয়ে শেরবুর্গ থেকে ২৭৪ জন যাত্রী তুলে নেয়। ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টায় আয়ারল্যান্ডের কর্ক পোতাশ্রয় থেকে জাহাজে ওঠেন ১১৩ জন তৃতীয় শ্রেণীর এবং সাতজন দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী।[১] বৃটেন থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় যাওয়া খুবই বিপজ্জনক ছিল। ছোটোখাটো জাহাজের পক্ষে বলা চলে জীবন বাজি রেখে যাত্রা করা। কেননা হঠাৎ সামুদ্রিক ঝড়- জলোচ্ছ্বাসে পড়ার আশঙ্কা সবসময়ই ছিল। তারপরও এত সংখ্যক যাত্রী সমুদ্রের রোমাঞ্চকর এই ভ্রমণ উপভোগ করার জন্য টাইটানিকের যাত্রী হয়েছিল। টাইটানিকের প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল ৩১০০ ডলার। আর তৃতীয় শ্রেণির ভাড়া ছিল ৩২ ডলার।
দুর্ঘটনার দিন দুপুরের ঘটনা
১৪ই এপ্রিল দুপুর দুইটার দিকে ‘America’ নামের একটি জাহাজ থেকে রেডিওর মাধ্যমে টাইটানিক জাহাজকে জানায় তাদের যাত্রাপথে সামনে বড় একটি আইসবার্গ রয়েছে। শুধু তাই নয় পরবর্তীতে ‘Mesaba’ নামের আরও একটি জাহাজ থেকে এই একই ধরনের সতর্কবার্তা পাঠানো হয় টাইটানিকে। এ সময় টাইটানিকের রেডিও যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন জ্যাক পিলিপস ও হ্যারল্ড ব্রীজ। দু’বারই তাদের দুজনের কাছে এই সতর্কবার্তাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তাই তারা এই সতর্কবার্তা টাইটানিকের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে পাঠান নি। টাইটানিক দুর্ঘটনার মাত্র ৪০ মিনিট আগে Californian সিপের রেডিও অপারেটর টাইটানিকের সাথে যোগাযোগ করে আইসবার্গটি সম্পর্কে বলতে চেয়েছিল কিন্তু টাইটানিকের রেডিও অপারেটর ক্লান্ত জ্যাক পিলিপস্ রাগান্বিত ভাবে বলে “আমি কেইপ রেসের সাথে কাজে ব্যাস্ত এবং লাইন কেটে দেয়।” ফলে Californian সিপের রেডিও অপারেটর তার ওয়ার্লেস বন্ধ করে ঘুমাতে চলে যায়। বলা চলে তাদের এই হেয়ালীপনার কারণেই ডুবেছে টাইটানিক।
দুর্ঘটনায় পড়া
যাত্রার পঞ্চম দিন সবাই যখন রাতের সমুদ্রের বুকে নিস্তিব্ধতার সাথী, ঠিক তখন বার্তা কক্ষে যে-ম্যাসেজটি সতর্কবাণী প্রচার করছিল তা হলঃ সামনের বৃহদাকার বরফখণ্ড টাইটানিকের চলার পথে বাঁধা হতে পারে। এগুলোর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এগুলোর মাত্রই আট ভাগের এক ভাগ পানির উপরে থাকে। মানে, এর বড়ো অংশটাই দেখা যায় না। কুয়াশাছন্ন সমুদ্রপথে টাইটানিকের গতিপথ পরিবর্তনে ক্যাপ্টেন স্মিথ তখনও কোন সিদ্ধান্ত নেননি। অবশেষে রাত পৌনে ১২ টার সময় টাইটানিক যখন উত্তর আটলান্টিক নিউ ফাউল্যান্ড এর কাছে পৌছায়, তখন থেকে কর্মরত ক’জন জাহাজকর্মীর চোখে বৃহদাকার হিমশৈল ধরা পরে। তাৎক্ষনিক সতর্ক ঘণ্টা বাজানো হয়।
এরপর খবর ব্রিজ রুম হয়ে পৌছায় বয়লার রুমে। বন্ধ করে দেওয়া হয় টাইটানিকের সকল ইঞ্জিন। ঘণ্টায় ২৩ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলমান টাইটানিক তখন শব্দহীন হয়ে পরে। শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে অতিক্রম করতে থাকে সবাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গতিহীন টাইটানিকের শেষাংশ ধাক্কা খায় সেই হিমশৈল এর সাথে। এর ডানদিক আইসবার্গের সাথে প্রচন্ড ঘষা খেয়ে চলতে থাকে। ফলে টাইটানিকের প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয়। টাইটানিক জাহাজটি যেই স্থানে ডুবেছিল সেই স্থানের নাম হলো ‘গ্রেট ব্যাংকস অফ নিউফাউন্ডল্যান্ড’। টাইটানিক সর্বোচ্চ ৪টি জলপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট নিয়ে ভেসে থাকতে পারতো। কিন্তু পানিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ৬টি কম্পার্টমেন্ট। এছাড়া জল প্রতিরোধ এর জন্য ১২টি গেট ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এমন জায়গায় জাহাজটির ধাক্কা লাগে যে, সবগুলো গেটের জল প্রতিরোধ বিকল হয়ে যায়। জলের ভারে আস্তে আস্তে জলে তলিয়ে যেতে থাকে টাইটানিক।
এই হৃদয়বিদারক ডুবে যাওয়া জলযানটির সবার মনে ছিল, আছে এবং থাকবে। প্রত্যেক যাত্রীই আপন প্রান বাঁচানোর জন্য লাইফ বোটে উঠতে যায়। কিন্তু লাইফ বোট ছিল মাত্র ১৬টি। তাই ক্যাপ্টেন নির্দেশ দিলেন- মহিলা ও শিশুদের আগে নামতে দিন। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে শুরু হয় যাত্রীদের লাইফ বোটে স্তানান্তরের কাজ।
বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের আগে লাইফ বোটে তোলার নির্দেশ দেন ক্যাপ্টেন। লাইোটেরটে ওঠা নিয়ে শুরু হয় এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। টাইটানিকের ঘড়িতে তখন রাত ১২টা ৩০মিনিট। লাইফবোটের বেশির ভাগই ছিল শিশু ও মহিলা। এটা একটা ভয়ংকর দৃশ্য।
সম্পূর্ণ অংশ তলিয়ে যাওয়া
রাত ২ টা থেকে ২ টা ২০ মিনিটের মধ্যে টাইটানিকের সম্পূর্ণ অংশ আটলান্টিকের বুকে তলিয়ে যায়। ডুবে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে জাহাজের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিকল হয়ে যায়।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের উদ্ধার
টাইটানিক যখন সমুদ্রের বুকে তলিয়ে যায় ঠিক তার এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর রাত ৪ টা ১০ মিনিটে সেখানে আসে ‘দি কারপাথিয়া’ নামের একটি জাহাজ। জাহাজটি সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো ৭০০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে সকাল সাড়ে আটটার দিকে নিউইয়র্কে চলে যায়। মোট ২২২৪ জন যাত্রীর মধ্য উদ্ধার করা হয় মাত্র ৭০০ জানকে। বাকী ১৫২৪ জন যাত্রীসহ সলিল সমাধি হয় বিশ্ববিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক এর।
ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া
দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৫ সালে যন্ত্রচালিত অনুসন্ধান শুরু করে একদল বিজ্ঞানী। রবার্ট বালার্ড নামক ফরাসি বিজ্ঞানী টাইটানিককে খুঁজে বের করেন। ১৯৮৫ সালে এর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আনসিংকেবল টাইটানিক এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৬০০ ফুট নিচে আটলান্টিকের তলদেশে স্থির হয়ে আছে। দ্বিখণ্ডিত জাহাজটির দুটো টুকরো ১৯৭০ ফুট দূরে অবস্থান করছে। টাইটানিকের সম্মুখভাগ সমুদ্রতলে ৬০ ফুট মাটির গভীরে প্রোথিত। ১৪ জুলাই ১৯৮৬, ঘটনার ৭৪ বছর পর টাইটানিক পুনরাবিষ্কৃত হয়।[২]সর্বশেষ ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ এর উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়।কিন্তু ২০ জুন ২০২৩ ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে যাওয়া ‘টাইটান’ সাবমেরিন ও উধাও হয়ে যায় এবং ৫ জন যাত্রী নিহত হন।টাইটানিকের জাহাজের পাশেই ‘টাইটান’সাবমেরিনের ও সলিল সমাধি।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট
আরও পড়ুনঃ চাঁদে মিলেছে অক্সিজেনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান