জাতির হৃদয়ে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ৫ম মৃত্যু বার্ষিকী আজ রোববার (১৪ জুলাই)। ২০১৯ সালের এই দিনে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি দেশের মানুষের অন্তরে অমর হয়ে আছেন।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তার অবদান অক্ষয় হয়ে আছে। দেশের উন্নয়ণ অগ্রগতির ইতিহাস থেকে কোন দিনই তাঁর অবদান মুছে ফেলা যাবে না। জনপ্রিয়তায় ঈশ্বার্নীত হয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে যারা পল্লীবন্ধুকে স্বৈরাচার উপাধি দিয়েছিলেন, তারাই সরকার গঠনের আশায় বারবার ঘুরেছেন পল্লীবন্ধুর দুয়ারে। জীবিত পল্লীবন্ধুর চেয়ে, মৃত পল্লীবন্ধু আরো শক্তিশালী এবং বেশি জনপ্রিয়।
১৯৩০ সালের ২০ মার্চ কুড়িগ্রাম শহরের “লাল দালান” বাড়ি খ্যাত নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন পেয়ারা নামের এক শিশু। বড় হয়ে পেয়ারা নামের সেই শিশুই পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নামে উন্নয়নের এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছেন বাংলাদেশে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নামে সাফল্যের সাথে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাফল্যের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন দীর্ঘ নয় বছর। প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাতীয় পার্টির মত একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। যারা পল্লীবন্ধুকে অপমান করতে স্বৈরাচার উপাধি দিয়েছেন, তারা সবাই ১৯৯১ সাল থেকে জোট ও সরকার গঠনে এরশাদের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন আশির্বাদ পেতে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিলেন এক অপরিহার্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
আরও পড়ুনঃ গণমানুষের রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই
বাংলাদেশের কতিপয় রাজনীতিবিদদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে স্বৈরাচার উপাধি দেয়া হয়, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। তিন জোটের রুপরেখা অনুযায়ী তিনি সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিপুল জনপ্রীয়তা প্রমাণ করেছেন।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান পল্লীবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ঐ সময়ে জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সকল নেতাকেই গ্রেফতার করা হয়। তিন জোটের রুপরেখা অনুযায়ী রেডিও এবং টেলিভিশনে বক্তৃতা দিতে দেয়া হয়নি জাতীয় পার্টিকে।
মামলা ও হামলার কারণে গণসংযোগ করতে পারেনি লাঙ্গল প্রতিক নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। কিন্তু ঐ নির্বাচনে জেলে থেকেই নির্বাচনে ৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন পল্লীবন্ধু। শত বাঁধার মধ্যেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চমক সৃষ্টি করেছিলো জাতীয় পার্টি।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও জেলের ভেতরে বন্দি থেকেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৫টি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রতিটি নির্বাচন, জোট ও সরকারগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো পল্লীবন্ধু এরশাদ ও তাঁর জাতীয় পার্টি। প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন এমন কোন নির্বাচনে পরাজিত হননি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমৃত্যু রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান ছিলো এমন জনপ্রীয় একজন রাজনৈতিক নেতাকে স্বৈরাচার উপাধি দিয়ে নিজেদেরই ঘৃণীত করেছেন কতিপয় রাজনৈতিক নেতা।
সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে এসে বিশ্ব ইতিহাসে যারা জনপ্রীয়তা পেয়েছেন পল্লীবন্ধু তাদের মধ্যে অনন্য। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজনীতিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে মৃত্যু বরণ করেছেন। এর আগে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ছিলেন তিনি।
মৃত্যুর পরে পল্লীবন্ধুর চারটি নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নেমেছে। আবার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পল্লীবন্ধুর জন্য রক্তের প্রয়োজন এমন সংবাদে হাজারো মানুষ ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
আরও পড়ুনঃ জ্বলছে সব জ্বলছে
মানুষের ঢল ঠেকাতে রেডিও-টেলিভিশনে ঘোষণা দিতে হয়েছিলো “পল্লীবন্ধুর জন্য আর রক্তের প্রয়োজন নেই”। শৃংখলা রক্ষার্থে তখন ঢাকা সেনানিবাসের সকল ফটকে জনসাধারণ প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তখন আবারো প্রমাণ হয়েছে, স্বৈরাচার উপাধি দিয়ে পল্লীবন্ধুকে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৪ সালের ৪ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মাজার জিয়ারত করে রাজনৈতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফাতেহা পাঠ করে দোয়া মুনাজাত করেছিলেন। যাকে স্বৈরাচার বলা হয় তিনিই বাংলাদেশের রাজনীতিতে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।
দেশের নোংড়া রাজনীতি যাকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছিলো তার ঐতিহাসিক কিছু র্কীতি তুলে ধরা হলো। সকল অপবাদ অগ্রাহ্য করে মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সেবা তৃণমূল মানুষের দোড় গোড়ায় পৌঁছে দিতে ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৮৩ সালের ৭ নভেম্বর এরমধ্যে ৪৬০টি উপজেলা পরিষদ সৃষ্টি করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
শহরের সকল সেবা গ্রামীণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে প্রতিটি উপজেলায় হাসপাতাল, মুন্সেফকোর্ট, পশু চিকিৎসা, কৃষি উন্নয়ণ সহ সকল সেবা নিশ্চিত করেছিলেন। প্রতিটি উপজেলায় শিক্ষা ও ক্রীড়া উন্নয়ণে নানামূখি পদক্ষেপ নেন। এসময় ৪২টি মহাকুমাকে জেলায় পরিনত করেন তিনি। এতে বাংলাদেশের জেলার সংখ্যা হয় ৬৪। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলা ও জেলা সদর দপ্তর নির্মান করেন। ১৯৮৮ থেকে ৯০ সালে সারা দেশে ৫৬৮টি গুচ্ছগ্রাম স্থাপণ করে ২১ হাজার ছিন্নমূল ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করেন।
জাতি গঠনের লক্ষ্যে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করেন পল্লীবন্ধু। শিক্ষাকে বাস্তবমূখি, বিজ্ঞান ভিত্তিক এবং অর্থনৈতিক চাহিদার পূর্ন উপযোগী হিসেবে ঢেলে সাজান।
আরও পড়ুনঃ কীভাবে হবেন একজন ভালো মানুষ?
প্রতি ২ কিলোমিটার এলাকা বা ২ হাজার মানুষের বসবাস এলাকায় একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কাজ শুরু করেন। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্য বই, খাতা ও পেন্সিল বিতরণ শুরুই করেন তিনি। চারটি শিক্ষা বোর্ডের পরিক্ষা একই দিনে নেয়া শুরু করেন।
প্রতিটি উপজেলায় একটি বালক ও একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং জেলা সদরে একটি কলেজকে আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেন। ২১টি কলেজকে জাতীয়করণ করেন। ৯টি কলেজকে বিশ্ব বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজ শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা ৭০ ভাগ বৃদ্ধি করেন
৬টি বিশ্ব বিদ্যালয় হল এবং ১৭টি কলেজ হোস্টেল নির্মাণ করেন। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে নিজের নামে কোন হোস্টেল নির্মাণ না করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান এর নামে দুটি হোষ্টেল নির্মাণ করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের জন্য দো-তলা বাস সহ অতিরিক্ত বাসের ব্যবস্থা করেন পল্লীবন্ধু। চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয় পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণ করেন। “পে অ্যাজ ইউ আর্ন” প্রকল্পে স্কুটার বরাদ্দ দিয়ে ছাত্রদের সম্পূরক আয়ের ব্যবস্থা করেন। কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নে নানা কর্মসূচি নেন। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত ইংরেজী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ৫০ ভাগ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করেন। মেয়েদের জন্য পৃথক ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
উপজেলা পর্যায়ে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৩ জন বিশেষজ্ঞসহ ৯ জন ডাক্তার নিয়োগ দিয়েছিলেন। পল্লী এলাকার ৩৯৭ টি উপজেলার মধ্যে ৩৩৩টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মান করেন। সরকারী হাসপাতাল গুলোতে পথ্যের জন্য বরাদ্দ ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করেন। সারাদেশে ২৫ হাজার দাইকে প্রশিক্ষনের আওতায় আনেন। প্রতিটি ইউনিয়নে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করে সেখানে অসুধ ও কর্মচারী নিশ্চিত করেছিলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেই শুরু হয়েছিলো।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন কৃষিকে। সেচ প্রকল্পাধীন চাষাবাদ বাড়ানো হয়েছিলো দ্বিগুন। সেচের জন্য ১৯৮৪ সালেই ১৭ হাজার ৩ শো গভীর নলকূপ, ১ লাখ ২৬শো অগভীর নলকূপ, ৪২ হাজার শো লো-লিফট পাম্প বসান। মুহুরী এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প নির্মান কাজ শেষ করেন। সহজ শর্তে কৃষি ঋণ বিতরণ করেন। গমের উৎপাদন বৃদ্ধি করেন ৫ গুন বেশি। উল্লেখযোগ্য হারে কৃষিঋণ বাড়িয়ে দেন তিনি। অনাবাদী জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হয়।
বিচার ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায় পৌছে দিতে রংপুর, যশোর, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেট এবং চট্টগ্রামে ৬টি হাই কোর্টের বেঞ্চ সম্প্রসারণ করেন। বিচার ব্যবস্থা দ্রুত করতে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি দন্ডবিধি এবং ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি সংশোধন করেন। একই উদ্দেশ্যে প্রতিটি উপজেলায় মুন্সেফ কোর্ট স্থাপণ করেন। যৌতুক নিরোধ আইন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন, মুসলিম পারিবারিক আইন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন জারি করেন। মামলার জট কমাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন পল্লীবন্ধু।
আরও পড়ুনঃ প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগের শিক্ষা
সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২ বছরে ২০৬টি উপজেলা সড়ক যোগাযোগের আওতায় আসে। ৮ হাজার কিলোমিটার পাকা সড়ক এবং ১৭ হাজার কিলোমিটারের বেশি কাঁচারাস্তা নির্মান করেন। ছোট-বড় ৫৮০টি সেতু নির্মাণ করেন। রাজধানীতে নর্থ সাউথ ও ওয়ারী খাল রোড নির্মাণ করেন।
মিরপুর-আগারগাঁও রোড প্রকল্প শুরু করেন। পান্থপথ ও রোকেয়া স্মরনী সড়ক নির্মাণ করেন। ফুলবাড়িয়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের ভীড় কমাতে তেজগাঁও, গাবতলী ও যাত্রবাড়ীতে তিনটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করেন। যানজট নিরসনে ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করেন। ঢাকা বন্যা নিরোধ বাঁধ নির্মাণ করেন। এতে ঢাকা শহর বন্যার জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেয়েছে আবার রাজধানীর বাইরে দিয়ে একটি বিশাল সড়ক নির্মিত হয়েছে। যাতে রাজধানী শহরের যানজট অনেকটাই কমেছে।
ঢাকা-মাওয়া বিকল্প সড়ক দ্রুততার সাথে এগিয়ে নেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিম্নাাঞ্চলীয় রাস্তা নির্মাণ করেন। চীনের সহায়তায় বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করেন। জাপানের সহায়তায় মেঘনা এবং মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা চুড়ান্ত করেন। খুলনা-মংলা এবং কুমিল্লা-চান্দিনা বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেন।
সিলেট থেকে ভৈবর হয়ে ঢাকা সড়ক নির্মাণ করেন। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় গ্রামঞ্চলের রাস্তা-ঘাটের ব্যপক উন্নয়ণ করেন। রেলওয়ে বোর্ড বিলুপ্ত করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল এবং রেলওয়ে পশি^মাঞ্চল নামে দুটি সংস্থা গঠন করেন। রেলওয়ের ৩০টি ইঞ্জিন, ১২ শো ৫৫টি মালবাহি বগি সংগ্রহ করেন। এবং ১০৬টি যাত্রীবাহী বগি সংগ্রহের উদ্যোগ নেন।
বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। রাজশাহী বিমান বন্দরের কাজ সমাপ্ত করেন। সিলেট ওসমানী বিমান বন্দর সম্প্রসারণ করেন। চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে বোয়িং ওঠা-নামার জন্য রানওয়ে সম্প্রসারণ করেন। ৪টি আধুনিক ডিসি ১০-৩০ বিমান ক্রয় করেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ভিআইপি টার্মিনাল নির্মাণ করেন। ২৮৭টি উপজেলায় হেলিপ্যাড নির্মাণ করেন।
২শো ১২ কোটি টাকা ব্যায়ে ২১২টি উপজেলায় উন্নত ডাক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ টেলিফোনে সরাসরি আন্তর্জাতিক ডায়ালিং করতে সমর্থ হয়। ১৯৮৩ সালে ৭৮টি উপজেলায় ৩০ লাইনের মেগনেটো এক্সেঞ্জ স্থাপন করেন।
অধিকতর সুষ্ঠু ও ন্যায় সঙ্গত কর-কাঠামো প্রবর্তন করেছেন এরশাদ। স্টক এক্সেঞ্জ পুনরুজ্জীবিত করেন। দেশের উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে স্বল্প সুদে গৃহ নির্মান ঋণ এর ব্যবস্থা করেন।
বেকরকারী পর্যায়ে শিল্প স্থাপনে উৎসাহ দিতে ৩৩টি পাটকল এবং ২৫টি বস্ত্রমিল থেকে পূঁজি প্রত্যাহার করে সেগুলো বাংলাদেশী মালিকদের কাছে প্রত্যার্পন করেন।
বিদ্যমান দু’টি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জীবন ও সাধারন বীমা ব্যবসা চালানোর অনুমতি দেন। চট্টগ্রামে রফতানী প্রক্রিয়াজাতকরণ জোনের কাজ শুরু করেন। নতুন শিল্পের মঞ্জুর দানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেন। ক্ষুদ্র, কুটির এবং হস্থচালিত তাঁত শিল্পের জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো ভেঙে আধুনিক ও বহুতল বিশিষ্ট ভবন তৈরী করেন।
ইটের ভাটায় কাঠের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করেন। কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে নানামুখি কর্মসূচি হাতে নেন।
অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম, যৌথ দল-কষাকষির এজেন্ট নির্ধারণ এবং ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচনের অনুমতি দেন তিনি। অধিক হারে বিদেশে চাকরী প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি এবং রিক্রুটিং এজেন্টদের হয়রানী বন্ধে অধ্যাদেশ জারি করেন। এছাড়া বিদেশে চাকরীর সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট লিঃ (বোয়েলস) নামে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী গঠন করেন। চট্টগ্রামে ইউরিয়া ও যমুনা (তারাকান্দি) সার কারখানা স্থাপন করেন।
আশুগঞ্জে ৬০ মেগাওয়াট শক্তি সম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট চালু করেন। চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, বরিশাল, ঘোড়াশাল এবং আশুগঞ্জে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্টেশন নির্মাণ সমাপ্ত করেন। ১২৬টি উপজেলায় বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু করেন। ২ বছরে পল্লীবিদ্যুতায়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৫ হাজার মাইল বিতরন লাইন নির্মাণ করেন।
বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের সাথে তিতাস গ্যাসের সংযোগের জন্য ৩২ মাইলব্যাপী ২০ ইঞ্চি লাইন স্থাপনের কাজ শুরু করেন। জয়পুরহাট কঠিন শিলা খনি এবং সিমেন্ট উৎপাদন প্রকল্পের অনুমতি দেন। তিতাস গ্যাসের ৬ নম্বর কূপ চালু এবং ৭ ও ৮ নম্বর কূপের সারফেজ গ্যাদারিং ফ্যাসিলিটিজ সংক্রান্ত দরপত্র আহবান করেন। সীতাকুন্ডে কূপের খনন কাজ দ্রুততার সাথে শুরু করেন।
ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক কাজ করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদাভাবে বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন ইভেন্টে টুর্নামেন্ট আয়োজন করেন। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে টুর্নামেন্টের আওতায় এনে ভবিষ্যতের জন্য খেলোয়ার তৈরীর পরিকল্পনা ছিলো তাঁর। সেসময় শিশুদের জন্য এরশাদ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট সারা দেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলো। বিভিন্ন ইভেন্টের মানোন্নয়নে ব্যাপক বরাদ্দ এবং পরিকল্পিতভাবে কোচিং এর ব্যাবস্থা করেছিলেন।
দূরদর্শী এরশাদ দেশের একমাত্র ক্রিড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি প্রতিষ্ঠা করেন। আজ সাকিব আল হাসান, মুসফিকুর রহিম, নাসির হোসেন, এনামুল হক বিজয়, সৈম্য সরকার, ও মমিনুল হকের মত বিশ্বখ্যাত তারকা ক্রিকেটার তৈরী হচ্ছে বিকেএসপিতে।
এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম টেষ্ট অধিনায়ক নাঈমুর রহমান, জাতীয় ক্রিকেটার আল শাহরিয়ার, নিয়ামুর রশীদ রাহুল, সজল চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, নাঈম ইসলাম, নাজমুল হোসেন, রাকিবুল হাসান, সাব্বির খান, সোহরাওয়ার্দী, শামসুর রহমান, মোহাম¥দ মিঠুন সহ অসংখ্য ক্রিকেটার তৈরী হয়েছে বিকেএসপি থেকে।
মিরপুরে দ্বিতীয় জাতীয় স্টেডিয়াম এবং ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ করেন। বনানীতে আর্মি স্টেডিয়াম নির্মাণ করেন। বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সংস্কার ও আধুনিকায়ণ করেন পল্লীবন্ধু। পুরান ঢাকার ৩টি খেলার মাঠ এবং ২৮০টি বিপণী বিশিষ্ট ধুপখোলা কমপ্লেক্স তৈরী করেন। ঢাকায় এক ডজনের বেশি শিশু পার্ক নির্মাণ করেন।
তিন দিনের টানা হরতাল সহ সকল রাজনৈতিক দলের বিরোধীতা উপেক্ষা করে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সৈন্য পাঠিয়ে দূরদর্শীতার স্বাক্ষর রেখেছেন পল্লীবন্ধু এরশাদ। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি সৈনিক স্বপ্ন দেখেন শান্তি মিশনে কাজ করার। আর জাতিসংঘ শান্তি মিশনে শ্রম, মেধা আর সততায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের ভামূর্তি উজ্জল করেছে।
সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে ঘৃণা করতেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন পল্লীবন্ধু। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের জন্য কল্যাণময় কাজ করেছেন তিনি। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের জন্য তাঁর ছিলো অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ।
জুমার নামাজকে বলা হয় গরীবের হজ্জ, তাই শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করেন পল্লীবন্ধু এরশাদ। এর আগে সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো রোববার। ১৯৮৮ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বাংলাদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষনা দেন তিনি। বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভবন সম্প্রসারণ এবং সৌন্দর্যবর্ধন করেন। বায়তুল মোকাররমকে জাতীয় মসজিদ ঘোষণা করেন। যাকাত তহবিল এবং যাকাত বোর্ড গঠন করেন। রেডিও এবং টেলিভিশনে আজান প্রচার শুরু করেন পল্লীবন্ধু।
২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে হিন্দু ধর্মকল্যাণ ট্রাষ্ট এবং বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ধর্মের প্রত্যেকটির জন্য ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে পৃথক কল্যান ট্রাষ্ট গঠন করেন। শুভ জন্মাষ্টমীর দিনকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা সহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকূফ করেন। প্রতিটি পূজা পার্বণে সরকারী বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যাপক উদ্যোগ নেন পল্লীবন্ধু।
সপ্তম শতাব্দিতে রাজা শশাঙ্ক এবং পরবর্তীতে সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের জন্য বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু করলেও পহেলা বৈশাখ এখন সকল ধর্ম ও বর্ণের বাঙালীর প্রাণের উৎসব। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদই পহেলা বৈশাখকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করেন।
সরকারী ছুটিতে বাঙালীর সব’চে বড় উৎসবে পরিণত হয় পহেলা বৈশাখ। পৃথিবীর সকল প্রান্তের বাঙালীরা দিনটিকে উৎসব মূখর করেন নানা আয়োজনে। এরশাদই ভেবে ছিলেন শুধু পহেলা বৈশাখেই বাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টানকে উৎসবের এক সূঁতায় বাঁধতে।
গণমাধ্যমের জন্য জাতীয় প্রেস কমিশন গঠন করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এছাড়া রেডিও এবং টেলিভিশন একত্রীকরণের মাধ্যমে জাতীয় সম্প্রচার সেল গঠন করেন। সরকার নিয়ন্ত্রিত দি বাংলাদেশ অবজারভার এবং চিত্রালীতে পূর্বতন মালিকানায় ফিরিয়ে দেন। দৈনিক বাংলা, বিচিত্রা এবং বাংলাদেশ টাইমস্ এর স্বাধীন ব্যবস্থাপনার জন্য “দৈনিক বাংলা ট্রাষ্ট” ও “বাংলাদেশ টাইমস ট্রাষ্ট” নামে ২টি ট্রাষ্ট গঠন করেন।
মুজিবনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। স্বল্প সময়ে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ সম্পন্ন করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর সম্প্রসারণ করেন। সংসদ ভবন এলাকার উন্নয়ন ও রমনায় জাতীয় তিন নেতার মাজার নির্মাণ সম্পন্ন করেন।
পুরনো গণভবনকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে রুপান্তর করেন। ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল সংস্কার করেন। জাতীয় ঈদগাহ এবং সচিবালয়ের সামনে নাগরিক সংবর্ধনা কেন্দ্র নির্মাণ করেন। নগর ভবন ও পুলিশ সদর দফতর নির্মাণ করেন। বিসিএস একাডেমী ও লোক প্রশাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
এছাড়া নানামুখি উন্নয়নে অবদান রেখেছেন পল্লীবন্ধু এরশাদ। রাজধানীসহ সারাদেশে এরশাদের কীর্তির অসংখ্য স্মৃতি অক্ষয় হয়ে আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মিরপুর ও গুলশান পৌরসভাকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে অন্তর্ভূক্ত করেন। চট্টগ্রাম পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
আত্মসমর্পনকারী পাবর্ত্য বিপথগামী উপজাতীয়দের সাধারন ক্ষমা এবং পুনর্বাসনে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। ন্যাশনাল ওয়াটার মাষ্টার প্ল্যান প্রনয়ন করেন। ১৯৮৫ সালের লক্ষমাত্র নির্ধারণ করে তিস্তা বাঁধ প্রকল্প নির্মান এগিয়ে নেন।
উত্তরা ও বারিধারায় নতুন প্লট বরাদ্দ দেন। নগরীর পানি ও বিদ্যুত লাইনের উন্নয়ন করেন। প্রতিটি সড়ক ও অলিগলিতে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করেন। নগরীতে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া উপজেলা ভিত্তিক তিনস্তরের প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন। জেষ্ঠতার ভিত্তিতে বন্ধ থাকা পদোন্নতি চালু করেন। গেজেটেড পদে মহিলাদের জন্য ২০ ভাগ পদ সংরক্ষণ করেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের জন্য রাজধানীর বনানীতে বাড়ি বরাদ্দ দেন। পথ শিশুদের জন্য পথকলি ট্রাষ্ট গঠন করেন।
নয় বছর রাষ্ট্র পরিচলানাকালে পল্লীবন্ধু অজস্র কল্যাণময় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার সুফল দেশ ও জাতি সম্মানের সাথে আজীবন উপভোগ করবে।
যারা পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে স্বৈরাচার উপাধি দিয়ে ছোট করতে চেয়েছেন, তারাই প্রকৃত অর্থে ছোট হয়েছেন। এরশাদকে সাধারণ মানুষের মাঝ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সকল প্রয়াস ব্যার্থ হয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পল্লীবন্ধু যেখানেই গেছেন, সেখানেই জনতার মহাসমুদ্র সৃষ্টি হয়েছে। জনতার এরশাদ, জনতার মাঝেই মহানায়ক হয়ে আছেন। জীবিত এরশাদের চেয়ে মৃত এরশাদ এখন অনেক বেশি শক্তিশালী।
লেখক- খন্দকার দেলোয়ার জালালী, সাংবাদিক এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এর সাবেক ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি।
❑ মুক্তকলাম থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ বর্ষাকালে বাংলার প্রকৃতিতে সৌন্দর্যের মেলা বসে