আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: কুমিল্লার মিষ্টির রাজা ‘রসমালাই’ । ১৯৩০ সালের দিকে কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুরে গড়ে ওঠে মাতৃভান্ডার। ওই বছর শীতল ভান্ডার ও ভগবতী পেড়া ভান্ডারও প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা মিষ্টি ভান্ডার। তারাই ছানার মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। এরপর আকৃতি পরিবর্তন করে রসমালাই। মূলত এ চার প্রতিষ্ঠান থেকেই কুমিল্লার রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
কুমিল্লা নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ২০০ গজ পূর্বদিকে মনোহরপুর। মনোহরপুরের একটি টিনশেড ঘরে তৈরি ও বিক্রি হয় মাতৃভান্ডারের রসমালাই। তার দুই পাশে ভগবতী পেড়া ভান্ডার ও শীতল ভান্ডার। উল্টোদিকে কুমিল্লা মিষ্টি ভান্ডারের অবস্থান। মাতৃভান্ডারের সামনে সারাদিনই ক্রেতাদের ভিড় থাকে। মাতৃভান্ডারের স্বত্বাধিকারী অনির্বাণ সেন গুপ্ত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তারা গুণগত মান ঠিক রাখার চেষ্টা করছেন। তার দাদা, বাবার পর বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছেন। বর্তমানে ২৫জন কারিগর কর্মরত আছেন এখানে।
মাতৃভাণ্ডারের জন্ম
জানা যায়, কুমিল্লা শহরের মনোহরপুর এলাকায় ১৯৩০ সালে ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামে দোকানে এই ‘রসমালাই’ বিক্রি শুরু হয়। খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামের দুই ভাই এ যাত্রা শুরু করেন। শুরুতেই তাঁরা রসের ভেতর ছোট ছোট আকারের মিষ্টি ডুবিয়ে বিক্রি করতেন, যা অল্প সময়ে খুব খ্যাতি লাভ করে। তখন এর নাম ছিল ‘ক্ষিরভোগ’। পরে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর অবাঙালিরা কুমিল্লায় এসে ক্ষিরভোগকে রসমালাই বলতে শুরু করে। কুমিল্লায় কোনো পর্যটক বা অতিথি এলে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন ঘটনা বিরল। জানা যায়, বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কুমিল্লার রসমালাইয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে।
মাতৃভাণ্ডারের প্রতিষ্ঠাতা খনিন্দ্র ও মনিন্দ্র সেন
আরও পড়ুনঃ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার বাকরখানি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খড়িয়ালা গ্রামের দুই ভাই খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন। ১৯৩০ সালে তাঁরা কুমিল্লায় আসেন এবং শহরের মনোহরপুর এলাকায় ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামে একটি দোকান দিয়ে ‘ক্ষিরভোগ’ বা ‘রসমালাই’ বিক্রি শুরু করেন। বর্তমানে মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের চাহিদা এককথায় আকাশছোঁয়া। ১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেন মারা গেলে একমাত্র ছেলে শংকর সেন মাতৃভাণ্ডারের পরিচালনা করা শুরু করেন। তবে এ দোকানের ছাউনির টিনগুলো পুরোনো আর জরাজীর্ণ। যদিও কয়েক বছর আগে সামনের অংশ কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে আসা এক ক্রেতা জানান, দোকানের অবয়ব দেখে মনেই হচ্ছে না যে এটি কুমিল্লার ঐতিহ্যের একটি অংশ।
মাতৃভাণ্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস জানান, মাতৃভাণ্ডার নামে এ মিষ্টি দোকান প্রতিষ্ঠার পর তাঁদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তাঁদের দোকানে উত্তম দে ও ক্ষিতিশ মোদক নামে দুজন অভিজ্ঞ কারিগর এই রসমালাই তৈরি করছেন। তাঁদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের কারিগররা রসমালাই তৈরি শিখে নিচ্ছেন। তবে মাতৃভাণ্ডারে গড়ে প্রতিদিন কত কেজি রসমালাই বিক্রি হয়, তা জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘খাঁটি রসমালাই, তাই চাহিদা আছে, বিক্রিও ভালো।’
১৯৩০ সালের দিকে মাতৃভান্ডারের মূল মালিক ইন্দুভূষণ দত্ত থেকে জায়গা নিয়ে মিষ্টির দোকান শুরু করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গভবনে বিদেশি অতিথিদের আতিথেয়তায়ও মাতৃভান্ডারের রসমালাই সরবরাহ হতো। তাছাড়া একসময় তারা ব্র্যান্ড হয়ে যায়। অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পেছনে পড়ে যায়।
মাতৃভান্ডারের স্বত্বাধিকারী অনির্বাণ সেন গুপ্ত বলেন, “ব্রিটিশ আমলে ঘোষরা মিষ্টি তৈরি করতো। একটা সময় বর্ণের পার্থক্য কমে আসে। হিন্দুদের বিভিন্ন বর্ণ ও মুসলিমরাও মিষ্টি তৈরি শুরু করে। পার্থক্য কমে আসায় আমরাও বংশ পরম্পরায় এ ব্যবসা ধরে রাখি। মন্দিরের কালী থেকে মায়ের নামটি নিয়ে এর নাম মাতৃভান্ডার করা হয়েছে।”
আরও পড়ুনঃ ভাগ্যকুলের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি এবং ঘোল
রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া খুবই সহজ বলে জানিয়েছেন এর কারিগররা। একটি পাতিলে বা কড়াইয়ে এক মণ দুধ দুই ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিলে তা ঘন হয়ে ১৩/১৪ কেজি ক্ষির তৈরি হয়। এর দুধ থেকে পাওয়া ছানার সঙ্গে পরিমাণমতো কিছু ময়দা দিয়ে খামির তৈরি করে বানানো হয় ছোট ছোট গুটি বা রসগোল্লা। এক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমাণ ময়দা দিয়ে এ গুটি বানানো যায়। মাতৃভাণ্ডারের কারিগর উত্তম দে জানান, এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষির তৈরি করে তাতে ছোট গুটি বা শুকনো রসগোল্লা দিয়ে ১৪ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়। এক মণ দুধে এর বেশি তৈরি করলে রসমালাইয়ের আসল স্বাদ আর থাকে না।’
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ১৯৯৪ সালের এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় সদস্য দেশগুলো। যার মধ্য দিয়ে প্রতিটি দেশ তার ভূখণ্ডে উৎপাদিত পণ্য, বস্তু ও জ্ঞানের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) আইনের মাধ্যমে নিবন্ধনের অধিকারপ্রাপ্ত হয়। তবে দীর্ঘদিন নজর না দেওয়ার পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনের অধীনে ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন হয়। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, বাংলাদেশের সুপরিচিত দুটি পণ্য কুমিল্লার রসমালাই ও খাদিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
ভেজালের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে স্বাদ
যে স্বাদ, গুণ আর ঐতিহ্যের কারণে রসমালাইয়ের চাহিদা ও খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছে সেই রসমালাই ভেজাল আর নকলের ভিড়ে জৌলুস হারাতে বসেছে। তাই আসল রসমলাইয়ের স্বাদ পেতে যেকোনো জায়গার দোকান হলে চলবে না, আসল স্বাদ পেতে হলে আসতে হবে কুমিল্লা শহরেই। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নকল ও ভেজাল রসমালাইয়ের ভিড়ে আসল রসমালাই চেনা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
কুমিল্লা শহর ও মহাসড়ক ঘিরে নকল রসমালাইয়ের অগণিত দোকান গড়ে ওঠায় আসল রসমালাইয়ের স্বাদ অনেকেই পান না। সত্যিকারের তৃপ্তির ঢেঁকুর তখনই দিতে পারবেন, যখন চিনে নিয়ে সঠিক জায়গা থেকে আসল রসমালাই কিনতে পারবেন। কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই পেতে হলে যেতে হবে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে। এখান থেকেই প্রায় ৯৪ বছর আগে অমৃত স্বাদের এই রসমালাই যাত্রা শুরু করে।
আরও পড়ুনঃ ১৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘সাবিত্রী’ মিষ্টি