আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: এক জীবনে নায়করাজ রাজ্জাক । ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্র যখন উর্দু, কলকাতার বাংলা ও হিন্দি সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল তখন হঠাৎ জহির রায়হানের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে নায়করাজ রাজ্জাকের। ১৯৬৮ সালে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সিনেমা জগতে পূর্ণাঙ্গ অভিষেক ঘটে নায়ক রাজ্জাকের। এর আগে সহকারী পরিচালক ও পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করলেও ‘বেহুলা’ আব্দুর রাজ্জাক নামের সাধারণ এক অভিনেতার নামের সঙ্গে নায়কের তকমা জুড়ে দেয়। তারপর একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিয়ে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন নায়করাজ। বাঙলা চলচ্চিত্রে তিনি রাজত্ব করেন পাঁচ দশক ধরে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫শ’র বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
নায়ক রাজ-রাজ্জাকের জন্ম কলকাতায়। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি । তার প্রকৃত নাম আব্দুর রাজ্জাক। টালিগঞ্জের মোল্লা বাড়ির আকবর হোসেন ও মা মিনারুন্নেসার ছোট ছেলে তিনি। জন্মের পর কলকাতাতেই বেড়ে উঠেছেন নায়করাজ। ছোটবেলায় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও তিনি হয়ে ওঠেন অভিনেতা।
আরও পড়ুনঃ বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের কালজয়ী এক পথিকৃতের নাম জহির রায়হান
কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মঞ্চ নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য তার স্পোর্টস শিক্ষক তাকে বেছে নেন। অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষকের কথায় তিনি অভিনয় করেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার অভিনয় দেখে সবাই মুগ্ধ হন। এই থেকেই তিনি অভিনয়ের আনন্দ পেতে শুরু করেন।
শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহীতে’ গ্রামের কিশোর চরিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়ে যুক্ত হন। কিন্তু অভিনয়ের কাজ করার ইচ্ছে থাকলেও প্রধান বাধা ছিল তার পরিবার। পরিবারের কেউ চাননি তিনি অভিনয় করেন।
তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজ্জাক ছিলেন সবার ছোট। বড় দুই ভাই ব্যবসা করছেন তাই তাকেও সেটি অনুসরণ করতে হবে এটি তিনি মেনে নিতে পারেননি। পরে মেজ ভাইয়ের সাহায্যে অভিনয় জগতে আসার সমস্ত সহযোগিতা পান রাজ্জাক।
এসএসসি পাশ করার পর রাজ্জাক কিছু অভিনেতার সঙ্গে অভিনয় করা শুরু করেন। নিজের প্রতিভার গুণে ধীরে ধীরে ছোট পর্দার নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ওই সময়েই রাজ্জাক কলকাতার নামকরা নাট্যাভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। অভিনয়ের অধ্যায় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের আরেকটি অধ্যায় শুরু করেন তিনি।
১৯৬২ সালে লক্ষ্মীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রাজ্জাক। সেসময় কলকাতায় অভিনয় করতে গিয়ে তার স্পর্শে আসেন খ্যাতিমান অভিনেতা উত্তম কুমার, তপন সিনহা এবং পরিচালক পীযূষ সাহা। পীযূষ সাহার কথাতেই ঢাকায় পাড়ি জমান নায়ক রাজ রাজ্জাক।
অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৬৪ সালে রাজ্জাক কলকাতা থেকে স্ত্রী লক্ষ্মী ও ছয় মাসের ছেলে বাপ্পারাজকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে তিনি থিয়েটারে কাজ শুরু করেন।
থিয়েটারে কাজ করতে করতে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর দু’বছর টেলিভিশন অভিনেতা হিসেবে কাজ করেন। ছোট পর্দায় ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের নজরে চলে আসেন রাজ রাজ্জাক।
অবশেষে রাজ্জাকের স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৬৮ সালে। জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’ প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। এরপর তাকে আর ফিরে তাকে হয়নি। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘আনোয়ারা’ আর তৃতীয় ‘আগুন নিয়ে খেলা’। এই ছবি বের হওয়ার আগেই তিনি সুপারস্টার খেতাবে ভূষিত হন তিনি।
নায়ক রাজ রাজ্জাক চলচ্চিত্রে প্রথম জুটি বেঁধে কাজ করেছেন জনপ্রিয় নায়িকা সুচন্দার সঙ্গে। এরপর একে একে কবরী, শাবানা, সূচনা, ববিতার সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করেন। তবে রাজ্জাক-কবরী জুটি এক অনবদ্য সৃষ্টি। যুগের পর যুগ শেষ হলেও এই জুটির খ্যাতি শীর্ষে।
চলচ্চিত্র জীবনে পাঁচ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করলেও তার তিন’শ ছবি রয়েছে যেখানে তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে গল্প। বাংলার পাশাপাশি উর্দু চলচ্চিত্রও রয়েছে তার ক্যারিয়ারে। আনোয়ার হোসেন, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল রানার মতো নামি-দামী অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করে নিজের সেরাটা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, এ প্রজন্মের মৌসুমী, রিয়াজ শাকিব খান’র মতো তারকাদের সঙ্গেও কাজ করেছেন।
নায়ক হিসেবে রাজ রাজ্জাক সর্বশেষ অভিনয় করেন ১৯৯৪ সালে ‘অন্ধবিশ্বাস’ চলচ্চিত্রে। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর চলচ্চিত্র থেকে বিরতি নেন। ফিরে আসেন সুপারহিট ‘বাবা কেন চাকর ছবির’ মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তখন তিনি কলকাতার চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শুরু করেন। দুই বাংলার চলচ্চিত্রে তিনিই ছিলেন নায়ক রাজ রাজ্জাক।
ব্যক্তিগত জীবনে রাজ্জাকের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে মারা গেছেন। বড় ছেলে জনপ্রিয় অভিনেতা বাপ্পারাজ ও ছোট ছেলে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় নায়ক সম্রাট।
চলচ্চিত্র জীবনে তিনি বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। পাঁচবার তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৩ সালে নায়ক রাজ রাজ্জাক জাতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। এ ছাড়া মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননাসহ বহু চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন।
২০১৭ সালের ২১ আগস্ট সন্ধ্যায় চির বিদায় নেন নায়করাজ-রাজ্জাক।
নায়ক রাজের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চলচ্চিত্র
‘বেহুলা’, আবির্ভাব, বেঈমান, টাকা আনা পাই, অবাক পৃথিবী, অলংকার, অবকাশ, অবুঝ মন, আলোর মিছিল, জীবন থেকে নেয়া, আশার আলো, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা, দুই পয়সার আলতা, চোখের জ্বলে, ছন্দ হারিয়ে গেলো, কাঁচ কাটা হিরে, কাজল লতা, কে তুমি, মানুষের মন, মাটির ঘর, মায়ার বাঁধন, মধুর মিলন, মনের মত বউ, রংবাজ, ময়নামতি, নাচের পুতুল, নীল আকাশের নীচে, ওরা এগারো জন, নতুন পৃথিবী, অমর প্রেম, পিচ ঢালা পথ, পরিচয়, প্রতিশোধ, পুত্রবধূ, সমাপ্তি, স্বরলিপি, সংসার, বাবা কেন চাকর ও সোনালী আকাশ।
আরও পড়ুনঃ এক রাত কম ঘুমালে আপনার ৭টি মারাত্বক ক্ষতি