আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: একজন ষ্টিভ জবস । ষ্টিভ জবস আমাদের সবার মাঝে অনেক দিন বেঁচে থাকবেন। মানুষ আরো কয়েক প্রজন্ম ধরে ষ্টিভ জবসের মতো কারো জন্য অপেক্ষা করবে। কেউ কেউ তার নোবেল পুরষ্কারের দাবি তুলেছেন। সত্যটা তো এই যে, তিনি আমাদের কোটি মানুষের জীবন যাত্রাকে পাল্টে দিয়েছেন। চলুন দেখি সেই মানুষটি সম্পর্কে
গল্প ও বুঝি এতটা রোমাঞ্চকর হয় না, যতটা ষ্টিভ জবস জীবন কাহিনী। একেবারে শূন্যে হাতে তিনি অ্যাপল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছিলেন। আর এক জীবনেই হয়েছেন যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের চেয়েও বেশি সম্পদের মালিক। এ অবস্থানে আসতে জবস যত বাধা পেয়েছেন ততটা বেশিজনের জীবনে আসেনি। প্রযুক্তি দুনিসয়ার মানুষের কাছে তিনি একজন সংগ্রামী মানুষেরই মানুষেরই প্রতিকৃতি।
স্টিভ জবস (পুরোনাম: স্টিভেন পল জবস) (ইংরেজি: Steven Paul “Steve” Jobs) (জন্ম ফেব্রুয়ারি ২৪, ১৯৫৫, মৃত্যু ৫ অক্টোবর ২০১১) যুক্তরাষ্ট্রের একজন উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবক। তাকে পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ বলা হয়। তিনি স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন-এর সাথে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি পিক্সার এ্যানিমেশন স্টুডিওস-এরও প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ১৯৮৫ সালে অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্যদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে তিনি অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের থেকে পদত্যাগ করেন এবং নেক্সট কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালে অ্যাপল কম্পিউটার নেক্সট কম্পিউটারকে কিনে নিলে তিনি অ্যাপলে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৯৫ সালে টয় স্টোরি নামের অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন।
যুদ্ধ দিয়ে শুরু
১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারী তাঁর জন্ম। অবিবাহিত মা-বাবার সন্তান ষ্টিভকে দত্তকে নেন পল ও ক্লারা জবস। ষ্টিভ নামটিও তাদের দেওয়া। ক্যালিফোনিয়ার হোমষ্টেড হাই স্কুলে শুরু হয় শিক্ষাজীবন। স্কুলে পড়া অবস্থায়ই চাকরি নেন হিউে লট-প্যাকার্ড বা এইচপিতে। এরপর “অ্যাটারি” নামের একটি ভিডিও গেইম তৈরির প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। ১৯৭৬ সালে বন্ধু ষ্টিভ ওজনেক আর রোনাল্ড ওয়েনকে নিয়ে অ্যাপল কম্পিউটার তৈরির কাজ শুরু করেন। সফল হওয়ার তুমুল ইচ্ছা ছাড়া বেশি কিছু সম্বল ছিল না। এর জোরেই তৈরি করে ফেলেন প্রথম কম্পিউটার “অ্যাপল” । ১৯৮৪ সালে ২৪ জানুয়ারী বাজারে আনেন বিশ্বের সবচেয়ে ছোট কম্পিটার “ম্যাকিনটোশ”। বাজার মাতিয়ে দিল নতুন প্রজম্মের এ কম্পিটার। এরপর একে একে ষ্টিভ বাজারে এনেছেন আইপড আইফোন ও আইপ্যাডের মতো পণ্য। অ্যাপল হয়ে উঠল প্রযুক্তি বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান।
আরও পড়ুনঃ এক জীবনে নায়করাজ রাজ্জাক
বৈচিত্র্যময় জীবন
বাবার ওপর খেপে ছিলে ষ্টিভ। ভুলতে পারেননি যে বাবা তাঁর দায়িত্ব নেননি। তাই বাবার সামনে যাননি কখনো। একটি বিট্রিশ ট্যাবলে য়ডকে জবসের বা জান্দালি বলেন, আমি তার সঙ্গে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছি। তাকে ই-মেইল করেছি। কিন্তু সে কখনো ই-মইেলে উত্তর দেয়নি, দেখা করেনি। এ ছাড়া ফোন করা হলে জবস ফোন রেখে দিত।
জবসের জম্মের কয়েক বছর পর জান্দালি ও জোয়ানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মোনা সিম্পসন নামে তাঁদের একটি কন্যাসন্তান হয়। কিন্তু ষ্টিভ জবস তাঁর বোনের ব্যাপারে জানতেন না। ১৯৮৫ সালে মোনা যখন একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তখন বিষয়টি জানেন জবস। এরপর থেকে তাঁরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
জবসের বয়স যখন ২৩ তখন তাঁর প্রেমিকা রি-অ্যানের গর্ভে সন্তান আসে। কিন্তু জবস এই সন্তানের বাবা হিসেবে নিজেকে অস্বীকার করেন। প্রায় এক বছর পর লিসা নিকোল নামের এই সন্তানকে মেনে নেন তিনি। মেয়ের প্রতি ভালোবাসা র স্বীকৃতিস্বরৃৃপ “লিসা” নামে একটি কম্পিউটারও তৈরি করেন জবস। জীবনে অনেকেরই প্রেমে পরেছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আমেরিকার সংগীতা শিল্পী জোয়ান বারেজ, হলিউড অভিনেত্রী ডায়ানে কিটন। জানা যায়, জবস জোয়ান বারেজকে বিয়েও করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে ষ্ট্যানফোর্ড এক অনুষ্ঠানে লনের পাওয়েল নামের এক ছাত্রীকে পছন্দ হয় জবসের। ১৯৯১ সালের ১৮ ই মার্চ তাঁরা বিয়ে করেন। চার সন্তানের বাবা জবস নিয়মিত সন্তানের ভালো-মন্দ ও লেখাপড়ার খোঁজ নিতেন।
অ্যাপল প্রতিষ্ঠা
১৯৭৬ সালের ১ এপ্রিল স্টিভ জবস, স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন।আমেরিকার উদ্যোক্তা মাইক মার্ককুলার প্রথম অ্যাপলে অর্থ বিনিয়োগ করেন। অ্যাপল প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৭১ সালে ইলেকট্রনিক্স হ্যাকার ২১ বছরের ওজনিয়াকের সাথে জবসের পরিচয় হয়। জবসের তখন বয়স ছিল মাত্র ১৬। ১৯৭৬ সালে তারা অ্যাপল ১ নামের প্রথম কম্পিউটার অবমুক্ত করে। ১৯৭৮ সালে মাইক স্কটকে প্রথম সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে কোমল পানীয় পেপসির সাবেক কর্মকতা জন স্কালীকে সিইও হিসেবে নিয়োগ করেন জবস। আশির দশকের শুরুতে জবসের আগ্রহেই অ্যাপল লিসা নামের ৯,৯৯৫ ইউএস ডলার মূল্যের ডেক্সটপ কম্পিউটার বাজারজাত করা শুরু করে। কিন্তু অধিক মূল্যের কারনে লিসা বাজারে সুবিধা করতে পারে নাই।
১৯৮৩ সালের অক্টোবরে জবস নতুন ধরনের ডেক্সটপ ম্যাকিন্টশ নির্মানের ঘোষনা দেন। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে অ্যাপল ম্যাকিন্টশের বাজারজাতকরন শুরু হয়। ১৯৮৫ সালের মে মাসে জবসকে অ্যাপলের ম্যাকিন্টশ কম্পিউটারের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। অক্টোবরে জবস অ্যাপল থেকে পদত্যাগ করেন এবং নেক্সট কম্পিউটার নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
নেক্সটষ্টেশন
অ্যাপল কম্পিউটার ছাড়ার পর জবস ১৯৮৫ সালে ৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার দিয়ে নেক্সট(NeXT) কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। নেক্সট কম্পিউটার থেকে জবস ১৯৯০ সালে নেক্সটষ্টেশন নামের পিসি বাজারজাত করন শুরু করেন। এই ওয়ার্কষ্টেশন গুলোর দাম ছিল ৯,৯৯৯ মার্কিন ডলার।
১৯৯৬ সালে অ্যাপল ঘোষনা দেয় ৪২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেক্সট কম্পিউটার ক্রয়ের। জুলাই ১৯৯৭ সালের পরে স্টিভ জবস পুনরায় প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলেও ২০০০ সালে প্রধান সিইও হিসেবে নিয়োগ পান। স্টিভ এ সময়ে কম্পিউটার যন্ত্রপাতি নির্মাণ ছাড়াও ডিজিটাল বিনোদনের নানা উপকরন নির্মাণে মনোযোগ দেন। তিনি ২৯ জুন ২০০৭ সালে প্রথম আইফোন বাজারজাত করন শুরু করে। নান্দনিকতার সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রনে বিনোদনের জগতে স্টিভ জবস একে একে প্রবর্তন করেন আইপড, আইপ্যাড।
ব্যবসায়িক জীবন
জবস অ্যাপল কম্পিউটারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে বছরে মাত্র ১ মাকিন ডলার বেতন গ্রহন করতেন।] কিন্তু তার কাছে ছিল অ্যাপলের ৫.৪২৬ মিলিয়ন শেয়ার এবং ডিজনীর ছিল ১৩৮ মিলিয়ন শেয়ার। ২০১০ সালের ফরবেসের হিসেবে তিনি ৮.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে ৪৩তম মার্কিন ধনী নির্বাচিত হন।
অক্টোবর ২০১১ পর্যন্ত স্টিভ জবসের নামে ৩৪২ টি আমেরিকান উদ্ভাবনের সত্ত্ব অধিকার রয়েছে।
সম্মাননা
স্টিভ জবস ১৯৮৫ সালে স্টিভ ওজনিয়াকের সাথে প্রথম ন্যাশনাল মেডেল অব টেকনোলজি লাভ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২০১১ সালে ৩২ জনের নাম ‘পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত করে। এ তালিকায় – আঙ্গেলা ম্যার্কেল, বারাক ওবামা, সিলভিও ব্যার্লুস্কোনি, লিওনেল মেসি প্রমূখ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি তিনিও স্থান পেয়েছেন৷
ক্যান্সারের দীর্ঘ যুদ্ধ
২০০৪ সালে জবসের লিভারে বিশেষ ধরনের টিউমার ধরা পড়ে। এই টিউমার থেকেই অগ্ন্যশয়ে ক্যান্সারের সংক্রমণ। ডাক্তাররা জানান। টিউমার অস্ত্রোপচার করলে তাঁর বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। আবার অপারেশন না করলেও রয়েছে প্রাণসর্ংশয় এ খবরে ভেঙে পড়েন অ্যাপলের কর্মকর্তা-কর্মাচারী এ পরিস্থিতিতে জবস অপারেশন করানেরা সিদ্ধান্ত নেন। অস্ত্রোপচার সফল হয়। এতে জবসের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ ফিরে পায় পুর্ োঅ্যাপল পরিবার। নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। কিন্তু ক্যান্সারটাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো। সবশেষ হওয়ার আগে দীর্ঘ আট বছর তিনি জটিল ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করেন। এ সময়কালে তিনি অ্যাপলে সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য আইপড, আইফোন, আইপ্যাড আইপ্যাড বাজারে ছাড়েন।
শোকাহত পুরো প্রযুক্তিবিশ্ব
জবস কেবল গুরুই নন, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বও বটে। প্রতিদ্বন্ধী প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠ^াতা বিল গেটসের সঙ্গেও ছিল তাঁর সখ্য। এক শোকবার্তায় গেটস লিখেছেন, “ হৃদয়ের গভীর থেকেই ষ্টিভের অভাব বোধ করছি। আমি সৌভাগ্য বলেই ষ্টিভের মতো এমন এমন বহু গুণী এবং ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার সঙ্গ পেয়েছি। ষ্টিভের মৃত্যুর ক্ষতি শুধু এই প্রজু নয়, পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম অনুভব করবে।
কেবল বিল গেটস নয়, জবসের মৃত্যুতে শোকাহত পুরো প্রযুক্তিবিশ্ব। যুক্তরাস্টের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ফেইসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক স্পিলবার্ড়সহ আরো অনেকে জবসের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন, এমনকি গুগলের হোমপেইজে ও সম্মান জানানো হয়েয়ে ষ্টিভ জবসকে।
সিলিকনভ্যালি মিস করবে তোমায়, জবস
মৃত্যুর পরপরই সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে খরবটি বেশ আলোড়ন তোলে, সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে জবসকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কোটি কোটি শোকগাথা। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে সিলিকনভ্যালি পাবে না নতুন কোনো ষ্টিভ জবস। তিনি কেবল একজন উদ্যোক্তাই ছিলেন না ছিলেন এক আদর্শ মডেল। তিনি দেখিয়েছেন শত সংগ্রাম করে কিভাবে সফলতা পেতে হয়। তিনি কেবল নতুন উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন দেখতেই শেখাননি. কিভাবে স্বপ্ন হাত ধরেই হয়তো চলে ব আরো কয়েক প্রজন্ম। তবে একজন ষ্টিভ জবস আর কখনো ফিরে প্রযুক্তিপণ্য। তবে তাঁকে ভোলা সহজ হবে না। যিনি পথ দেখান. তিনি সঙ্গেই থাকেন।
আরও পড়ুনঃ গাজায় ইসরাইলি তাণ্ডব, সোয়া লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত