আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ ডেস্ক: ই-সিগারেট ‘আশীর্বাদ না অভিশাপ । ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে ধূমপানকে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং বলে। এ যন্ত্রের ভেতরে নিকোটিন, পানি ও সুগন্ধির দ্রবণ থাকে। ই-সিগারেটে নিকোটিন তরল আকারে থাকে, যা তাপে ধোঁয়া তৈরি হয়। সিগারেটের বিকল্প হিসেবে অনেকে ই–সিগারেট ব্যবহার করেন। ই-সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা এখনো অজানা। এ নিয়ে নেই কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে এটি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। ভারতেও ই–সিগারেট উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কানাডাসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশে তরুণসহ বিভিন্ন বয়সী লোক সিগারেটের বিকল্প হিসেবে দিন দিন ই-সিগারেটে ঝুঁকছেন। তবে বাংলাদেশে ই-সিগারেট ও এর বিভিন্ন উপাদান উৎপাদিত হয় না। কিন্তু আইনে নিষিদ্ধ না হওয়ায় বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানি ও বিপণন নিষিদ্ধ নয়। নিষিদ্ধ না হওয়ায় এর মান নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারিতেও সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নেই।
আরও পড়ুনঃ এক রাত কম ঘুমালে আপনার ৭টি মারাত্বক ক্ষতি
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
জাতীয় হৃদরোগ ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্রের চিকিৎসক অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, সিগারেটের চেয়ে ই-সিগারেটে নিকোটিন বেশি পরিমাণে বের হয় বা সেবন হয়। এতে আসক্তি বাড়ে। এ ছাড়া বাজারে সস্তায় যেসব ভ্যাপ জুস পাওয়া যায়, এগুলোতে কী উপাদান থাকে, তা অজানা। নিকোটিন ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। আর ভ্যাপ জুসে রাসায়নিক উপাদান বেশি বেশি সেবনে ফুসফুসের আরও ক্ষতি করে। তাই এখনই সরকারের উচিত এর বাজারজাত নিষিদ্ধ করা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ই-সিগারেটকে হিট-নট-বার্ন বা যে নামেই অবহিত করা হোক না কেন, এ ধরনের পণ্যকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০টি সিগারেটের সমান ক্ষতি করে একটি ই-সিগারেট।
ই-সিগারেট ব্যবহারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। এর মধ্যে যে উপাদানগুলো পাওয়া যায় তা শরীরের বিভিন্ন সেলকে বিকলসহ ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। এতে যে তরল পদার্থ (ই-লিকুইড) থাকে সেখানে প্রোপাইলিন গ্লাইকল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইকল, নানাবিধ ফ্লেভার ও নিকোটিন থাকে। এ রাসায়নিকগুলো গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়ার সমপরিমাণ ফরমালডিহাইড উৎপন্ন করে। যা মানবশরীরের রক্ত সঞ্চালনকে অসম্ভব ক্ষতি করে।
ই-সিগারেটের নিকোটিন আল্ট্রাসনিক, এগুলো ফুসফুসের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে শ্বাসতন্ত্রে রোগ তৈরি হয় এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। ফুসফুসের কোষগুলো নষ্ট হতে হতে এমন অবস্থা তৈরি হয়, যা আর কখনওই ভালো হয় না।
ই-সিগারেটের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘মানুষের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট (মস্তিষ্কের উন্নয়ন) ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত চলমান থাকে। ই-সিগারেট ব্যবহারের কারণে শিশু-কিশোরদের এটি ব্যাহত হয়। ই-সিগারেট একটি নেশা তৈরি করে। আর নেশাগ্রস্ত হলে একটি মানুষ অসামাজিক হয়ে যায়। যখন সে ই-সিগারেট না পায়, তখন সে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তার আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন আসে।
‘ই-সিগারেটের নিকোটিন আল্ট্রাসনিক, এগুলো ফুসফুসের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে শ্বাসতন্ত্রে রোগ তৈরি হয় এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। ফুসফুসের কোষগুলো নষ্ট হতে হতে এমন অবস্থা তৈরি হয়, যা আর কখনওই ভালো হয় না।’
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, টোব্যাকোর মাধ্যমে যে ক্ষতিগুলো হয় তার প্রত্যেকটি ই-সিগারেটের মাধ্যমে হয়। এটি মানুষের জন্য যে ক্ষতিকর, সেটি চিহ্নিত করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্দোলন হচ্ছে। মেডিসিন ও মানসিক চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সোসাইটিগুলো ই-সিগারেটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
ই-সিগারেট, ভ্যাপ বা সিসা— তরুণদের নেশার জগতে নিয়ে যায়, এমন সবকিছু নিষিদ্ধ করতে হবে। এর বিপরীতে তাদের জন্য খেলাধুলার মাঠ, বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আমাদের শিশু-কিশোরসহ সব তরুণকে নেশার ছোবল থেকে রক্ষার জন্য একটি জাতীয় গাইডলাইন থাকা উচিত— জানিয়ে এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, গাইডলাইনের মধ্যে তামাক বা তামাকজাত পণ্য নিষিদ্ধ থাকবে। ই-সিগারেট, ভ্যাপ বা সিসা— তরুণদের নেশার জগতে নিয়ে যায়, এমন সবকিছু নিষিদ্ধ করতে হবে। এর বিপরীতে তাদের জন্য খেলাধুলার মাঠ, বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ বিকাশমান শিশু-কিশোরদের যদি আমরা সৃজনশীল পথে পরিচালিত করতে না পারি তাহলে তারা নেশার বিষাক্ত নীল ছোবল থেকে বাঁচতে পারবে না।
আমাদের দেশে এখনই ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা উচিত— এমন দাবি তুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ই-সিগারেট আসার পর প্রচার করা হলো যে এটি প্রচলিত তামাক তথা নিকোটিনে ভরপুর সিগারেটের চেয়ে নিরাপদ। উপরন্তু এটি প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারীদের ধূমপানের অভ্যাস থেকে দূরে রাখতে কার্যকর। এভাবে প্রচার করা হলো। আসলে সেরকম কিছুই ঘটল না।
ভারতসহ ৫০টিরও বেশি দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নরওয়ে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের ওপর বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আমাদের দেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিগারেটের বাজারের তিন-চতুর্থাংশ দখল করে নেয় নবাগত ই-সিগারেট। গতানুগতিক সিগারেটের চেয়ে নতুন এ সিগারেটের চাহিদা জনগণের কাছে বাড়তে থাকে। পরিকল্পনা অনুসারে এর মূল ক্রেতা প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারী হওয়ার কথা থাকলেও তা হলো না। উল্টো অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীরা, যারা কখনও ধূমপানই করেনি, তারা এ সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ল। আসলে ই-সিগারেট বিভিন্ন আকার, স্বাদ ও গন্ধে পাওয়া যাওয়ায় তা সবার কাছে সমাদৃত হয়। তবে এর কুফল যে সাধারণ সিগারেটের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়, বিষয়টি অনেকেই অগ্রাহ্য করল। ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ই-সিগারেট সেবনের ফলে ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে। এক হাজারেরও অধিক মানুষ ফুসফুসের মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়।
ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত আরও বলেন, ইতোমধ্যে ভারতসহ ৫০টিরও বেশি দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো কোনো দেশ এ ধরনের সিগারেট কারও মালিকানায় থাকার ওপরও দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নরওয়ে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের ওপর বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
ই-সিগারেট সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো:
ইলেকট্রনিক সিগারেটগুলো কম ক্ষতিকর বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু এটা মোটেও সত্য নয়। উচ্চ ভোল্টেজের এই সিগারেটে ফরমালডিহাইড উৎপন্ন হয় যাতে সিগারেটের মতোই স্বাদ আসে। এতে ক্যান্সারের ঝুঁকির মাত্রা দীর্ঘ দিন ধরে স্বাভাবিক ধূমপানের চেয়ে ৫-১৫ গুণ বেশি থাকে।
একে নিরাপদ ইলেকট্রিক যন্ত্র বলেই মনে করা হয়। কিন্তু তা মোটেও নিরাপদ নয়। ই-সিগারেট আপনার মুখে বিস্ফোরিত হতে পারে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, চার্জারে সমস্যা থাকলে সিগারেট বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এতে বিষাক্ত পদার্থ থাকে না বলে ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। আমেরিকান ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তাদের গবেষণায় জানায়, এতে কার্সিনোজেনস এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গেছে।
ই-সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপান করা হলেও তা সরাসরি সিগারেট খাওয়ার সমান নয় বলে মনে করা হয়। এই ভুল ধারণা সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন সবার। কোনো গবেষণায় প্রমাণ মেলেনি যে, এর ধোঁয়া ক্ষতিকর নয়।
ইলেকট্রনিক সিগারেটে ক্যান্সার হয় না বলে দাবি করা হয়। আসল তথ্যটি হলো, এতে ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ রয়েছে। তা প্রথম পয়েন্টেই তুলে ধরা হয়েছে। তা ছাড়া কেউ একাধারে বহু বছর এই সিগারেট না খেলে এর সত্যিকার প্রভাব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া কঠিন বিষয়।
ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণ আইন
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। আইনটি ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। আইনটি আবার সংশোধন করার কার্যক্রম চলমান। আইনটি সংশোধনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তিনটি সভা করেছে। এবারের সংশোধনীতে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
২০১৯ সালে ভারতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ হলে বাংলাদেশও আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে সে উদ্যোগ তখন সফল হয়নি।
জানতে চাইলে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের প্রোগ্রাম অফিসার মো. ফরহাদুর রেজা বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে ই-সিগারেটের ক্ষতিকর দিকগুলোর বিষয়ে জানা যাচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন ঝুঁকি আছে। ক্ষতিকর বলেই বিভিন্ন দেশ এটি নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির সংশোধনী খসড়া পর্যায়ে আছে। এবারের সংশোধনীতে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থাকতে পারে।
রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানে ই-সিগারেটের যন্ত্র ও এর উপাদান কিনতে পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে ভ্যাপিং ক্লাবও। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও এ–সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এগুলো মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা। এটি ৫৫০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকার মধ্যে কিনতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া সুগন্ধিযুক্ত দ্রবণ (ভ্যাপ জুস), ব্যাটারি, ফিল্টার ও কয়েলও বিপণিবিতানগুলোতে কিনতে পাওয়া যায়।
তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, দেশে ব্যাপক হারে ছড়ানোর আগে এখনই সরকারের উচিত ই-সিগারেট আমদানি, বাজারজাত ও বিপণন নিষিদ্ধ করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বে খুব ধীরগতিতে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমছে। সংখ্যাটি এক বিলিয়নের বেশি। তবে ই-সিগারেটের চিত্র ভিন্ন। এর ব্যবহারকারী দ্রুত বাড়ছে। ২০১১ সালে ই-সিগারেট ব্যবহারকারী ছিলেন ৭ মিলিয়ন, ২০১৮ সালে বেড়ে হয় ৪১ মিলিয়ন। বাজার বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটর বলছে, বিশ্বে ২০২১ সাল নাগাদ ই-সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫৫ মিলিয়ন ছাড়াবে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট
আরও পড়ুনঃ আজ হাবু’র বিয়ে