আশুরার তাৎপর্য ফজিলত ও আমল
মুসলমানদের কাছে আশুরা অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই এ দিনটি ছিল পবিত্র ও সম্মানিত। প্রাচীন আরবের রীতিতে যে মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম ছিল তন্মধ্যে মহররম অন্যতম। আল্লাহ নিজেই এ মাসকে ‘মর্যাদাপূর্ণ’ বলে ঘোষণা করেছেন। ‘মহররম’ শব্দের অর্থও সম্মানিত।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গণনা হিসাবের মাস হলো বারোটি। যেদিন থেকে তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে চারটি মাস বিশেষ সম্মানিত’ (সুরা তওবা : ৩৬)। এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে বারো মাস হলো-মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হলো-মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ। এ মাসেরই দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা।
আশুরা শুধু কারবালাকেন্দ্রিক নয় : কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির বহু আগে থেকেই আশুরার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত। এদিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়, হজরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি দেওয়া, হজরত মুসা (আ.) তুর পর্বতে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন, তাঁর শত্রু ফেরাউনের নীল নদে ভরাডুবি হয়।
এদিনে হজরত আইয়ুব (আ.) রোগ থেকে মুক্তি পান। হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর প্রিয় পুত্রকে ফিরে পান। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে দজলা নদীতে বের হয়েছিলেন এদিনে। হজরত সুলাইমান (আ.) এদিনে পুনরায় রাজত্ব ফিরে পান। হজরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাঁকে আকাশে তুলে নেওয়া হয় এদিনেই।
আরও পড়ুনঃ পবিত্র আশুরার শিক্ষা ও তাৎপর্য
হজরত জিব্রাইল (আ.) সর্বপ্রথম আল্লাহর রহমত নিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে আগমন করেছিলেন। মহররমের কোনো এক শুক্রবার ইস্রাফিল (আ.)-এর শিঙায় ফুৎকারের মাধ্যমে পৃথিবী ধ্বংস হবে।
নবীজির ইন্তেকালের কয়েক দশক পর ৬০ হিজরির এদিনেই প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হোসাইন (রা.) ফুরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্যতম বর্বর হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে ইয়াজিদের পিশাচ বাহিনী। কারবালার ঘটনা নিঃসন্দেহে জঘন্যতম এক ঘটনা। এ ঘটনা আমাদের শেখায় হকের পক্ষে অবিচল থাকার, ত্যাগ ও আত্মত্যাগের এবং জালিমের সামনে মাথা নত না করার শিক্ষা।
শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতেহজরত নূহ (আ.)–এর আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা জোগায়।
আশুরার দিনের আমল : কারবালার ঘটনার বহু আগেই বিশ্বনবী (সা.) হাদিস বর্ণনা করেছেন। রমজানের পর মহররম মাসের রোজা সবচেয়ে উত্তম বলে বর্ণনা করেছেন নবীজি (সা.)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।
আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হচ্ছে রাত্রিকালীন নামাজ’ (মুসলিম : ১১৬৩)। আর মহররমের রোজার মধ্যে আশুরার রোজার ফজিলত আরও বেশি। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি’ (বুখারি : ১/২১৮)।
দুটি রোজা রাখা : এ ধরনের আরও অনেক হাদিস রয়েছে যেগুলোর দ্বারা বোঝা যায়, আশুরার দিনের রোজা সুন্নত এবং বরকতময়। তবে রোজা রাখার ক্ষেত্রে বিশ্বনবীর নির্দেশনা হলো-তোমরা এই রোজার ক্ষেত্রে ইহুদিদের বিরোধিতা করো। অর্থাৎ তারা শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখে। আর তোমরা ১০/১১ অথবা ৯/১০ তারিখ রোজা রাখবে। এর বাইরে আর যত কিছু আছে মাতম, মিলাদসহ সবকিছুই বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। মিছিল, আতশবাজি ফোটানো, বিশেষ খাবার রান্না করা এসবের কোনো নিয়ম নেই।
এ ছাড়া এদিনের বিশেষ নামাজ, বিশেষ দোয়া-দরুদ বা আমল নেই। তবে স্বাভাবিকভাবে অন্যদিনের মতোই এদিন নফল আমল করতে পারবেন। তবে নফল রোজার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
পবিত্র আশুরার এই দিনে সাম্য, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও অব্যাহত অগ্রগতি কামনা করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক নিয়ম মেনে আশুরা পালন করার তওফিক দান করুন। আমীন
❑ সম্পাদকীয় থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ হিজরি নববর্ষ হোক জীবনকে ঢেলে সাজানোর নতুন আত্মপ্রত্যয়