আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার আমলে কারাগারে আমার ৪০ দিনের নির্মম গল্প
শুরুতেই বলি,আমার পরিবার এর কোন রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নাই, কখনোই ছিলনা। আমি স্কুল জীবন থেকেই একজন হাবাগোবা, বেকুপ মার্কা ছেলে হিসেবে পরিচিত। আমি সেই স্কুল থেকেই রাজনীতি ত দূরের কথা, ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পেতাম না।
রাজনীতি নিয়ে আমার কোনদিন কোন ইন্টারেস্ট জাগে নাই সেকাল একাল। স্কুল জীবন কোনরকম পার করে কলেজ জীবনে আসলাম।কলেজ জীবনে একাডেমিক পড়াশোনা আমি বলতে গেলে একদম করিইনাই কিন্তু কলেজ জীবন থেকেই আমার দু একজন ঢাবির বড় ভাই আর আমার ফ্রেন্ড নিশান থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলাসিতা সম্পর্কে সবসময় শুনে আসতাম যেটা আপনারাও শুনে আসছেন হয়তো।
এই থেকেই আমার মনে সবসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর জন্য আলাদা একটা আবেগ তৈরি হই গেছিল। যেভাবেই হোক, আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়া চাই।
এই নিয়ে, ইন্টার পরীক্ষা কোনমতে শেষ করে চট্টগ্রাম শহরে রওনা দিলাম,সাথে ছিল মাইন, তারেক ভাই।নিশান,মেহেদি আগে থেকেই শহরে একটা মেচ এ ছিল।তারপর আমরা ৬ বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম শহরে চকবাজার এলাকার, রসুলবাগ আবাসিক এ একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম।
একটা কোচিং এ আমরা এডমিশন টেস্ট এর জন্য ভর্তিও হলাম। শুরু হই গেল আমাদের ঢাবি এর জন্য প্রিপেশন। দিন,রাত,সকাল,দুপুর সবাই পড়াশোনা নিয়েই থাকতো। পড়াশোনা ছাড়া আমরা এক্সট্রা কোনদিন কোনকিছু নিয়ে আলোচনা করিনি।যা আলোচনা ছিল তা শুধুই পড়াশোনা কারণ উদ্দেশ্য ছিল সবারই এক – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বলে রাখি,আমি এবং মাইন সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড এর।আমরা ‘ক’,’ খ’ ইউনিট এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।অপরদিকে নিশান, মেহেদী ‘গ’ ইউনিট। আর তারেক ভাই চীন চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এদিকে ৩ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে।ঘনে আসলো ঢাবির ‘গ’ ইউনিট এর পরীক্ষা।
সময়টা ছিল ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সাল,রাত ১ টা,শুক্রবার। নিশান আর মেহেদি সেদিন রাতে ১০ টায় ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিছিল কারণ তার দু একদিন পরেই তাদের ‘গ’ ইউনিট পরীক্ষা। সেই রাত ফ্ল্যাটে আমি আর মাইন ছিলাম শুধু। হঠাৎ রাত ১ টা বাজে কারা যেন আমাদের দরজা খুব জোরে জোরে নক করতেছিল।তাড়াতাড়ি করে দরজা খুললাম।
আরও পড়ুনঃ গণমানুষের রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই
খুলে দেখলাম কিছু পুলিশ বাহিনী বাইরে দাড়ানো। তারা আমাদের অহেতুক ধাক্কা মেরে, কোন পারমিশন ছাড়াই, কোন কথাবার্তা ছাড়াই আমাদের বাসায় ঢুকে আমাদের পড়ার টেবিল,ছাদ,কিচেন, বাথরুম সবকিছু উল্টো পাল্টা কইরা কি যেন খুজতেছিল। আমি কর্তব্যরত একজন এসআাই পুলিশ কে জিজ্ঞেস করলাম “আংকেল আপনারা কি খুজতেছেন আমাদের বাসায়? ” তিনি আমাকে কোন কথাবার্তা না বলেই থাপ্পর দি দিল।
আমি স্বভাবতই ভীতু প্রকৃতির মানুষ, তাই চুপ করে দাড়িয়ে দেখতেছিলাম সব। এরি মাঝে,আমাদের বাসা পুরো তছনচ করে তারা বই ছাড়া আর কিছু পাইলো না। তারপর, পুলিশটা আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করা শুরু করল।পরিচয় দিলাম।শহরে আমরা কেন আসছি,আমরা স্টুডেন্ট সবি বললাম।
আমাদের বইপত্র খুলেও দেখালাম দ্যাট আমরা এডমিশন ক্যান্ডিডেট, আমরা এখানে আপনারা যা ভাবতেছেন তা করতে আসিনি,শুধুই পড়াশোনা করতে আসছি,আমাদের কি অপরাধ স্যার? এরি মাঝে এন্ট্রি দিল বাকলিয়া থানার ওসি “মঈনুল” কি মাঈনু নামটা সঠিক মনে নেই।
এসেই ইনি অর্ডার দিল আমাদের এরেস্ট করতে। আমরা তখন কান্না করে করে জিজ্ঞেস করলাম স্যার আমরা কি করসি? তিনি খুব সুন্দর করে বললেন তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হবে।তুমাদের কিছুই করা হবেনা। এই বলে তার বাহিনী আমাদের এরেস্ট করে গাড়ি তে তুলল।
আরও পড়ুনঃ জাতির হৃদয়ে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
গাড়িতে এসে দেখলামা আর ১১ জন মত স্টুডেন্ট, আমারা ২ জন সহ মোট ১৩ জন,সেম বিল্ডিং এর যাদের চেহেরা আমরা কোনদিন দেখিও নাই। তাদের থেকে শুনলাম এই বিল্ডিং এর একটা ফ্ল্যাট এর কাউকে কিছু করিনি কারণ তারা ছাত্রলীগের ছেলে ছিল।
যেটাইহোক,আমি স্টিল পজিটিব ছিলাম,মাইন কে বলতেছিলাম আমরা তো কোন অপরাধ করিনি, ভয় নেই।এভাবে হাসিমুখে আমাদের কে বাকলিয়া থানায় আনা হলো। বলে রাখি,আমাদের সাথে পরিবার এর কারো সাথে যোগাযোগ করতে দেয়া হইনি।আমাদের মোবাইল নিয়ে ফেলছিল অনেক আগেই। থানা তে ঢুকার পর পরই তারা আমাদের সবার নাম একটা ডায়েরি তে লিখে ফেলল। সেই রাত আমরা কেউ ঘুমায়নি।
সকাল হলো,সকাল ৯ টা বাজে চলে আসলো আমাদের প্রিয় সময় টিভি, আমাদের নিয়ে তাদের রিপোর্ট কি ছিল জানেন? আমরা শিবির,জঙ্গি। আমরা নাকি রাতে বোমা বানাচ্ছিলাম, সামনের নিবার্চন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। সকাল ১০ টা বাজে দিল আমাদের নামে মামলা অথচ কথা ছিল আমাদের সকাল সকাল বাসায় দিয়ে আসার।মামলা কি ছিল জানেন? “বিস্ফোরক মামলা”।আমরা নাকি সেই রাতে বোমা বানাইতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা খাইছি।
সাথে আরো একটা মামলা দিছিল “বিশেষ ক্ষমতায়ন মামলা”, যেই মামলার বাদি আমাদের সরকার। তাদের মতে,আমাদের মতো সদ্য ইন্টার পাশ করা পড়ুয়া এই ছেলেগুলি নাকি দেশদ্রোহী, আমার নাকি মেস এ বসে দেশ আক্রমণ এর নীল নকশা তৈরি করতেছিলাম।
এদিকে আমাদের পরিবার এর কাছে আমাদের খবর পৌছায় গেছিল।আমার পরিবার আমাকে শহরে পাঠাইছিল যাতে তারা দেখতে পারে আমি একটা সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশোনা করি, আমার জীবন সুন্দর করে গড়ে তুলি কিন্তু তারা কি দেখল? তারা দেখল তার ছেলে কে রশি দিয়ে বেধে, একজন হত্যাকারী আসামি এর মতো করে এই ফ্যাসিস্ট সরকার এর বাহিনী প্রিজন ভ্যান এ তুলতেছিল। আমাদের ১ দিন রিমান্ডে নেয়া হলো, তারপর জেলে নেয়া হলো।
জেলে ঢুকানোর পর, যখন সেখানে অবস্থানরত দায়িত্বপ্রাপ্ত আসামীরা আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেছিল,মারতেছিল এমনে এমনে তখন আমার তাদেরকে বলতে ইচ্ছে করত,ভাই আমি কি করছি?আমি কি অপরাধ করেছি? আমি ত কিছু করিনি,আমি এখানে কেন? আপনারা কেন আমাদের সাথে এরকম বিহেব করতেছেন?
আরও পড়ুনঃ কীভাবে হবেন একজন ভালো মানুষ?
আমার চোখ দিয়ে পানি পরত আর জিজ্ঞেস করতাম নিজেকে আমি কি করেছি ভাই? কেন আমি এগুলা ফেস করব? কেন করব?
এদিকে আমার এলাকায় আমাকে সবাই ঠিকি ভেবে নিছিল আমি জঙ্গি, আমি শিবির। তারা ভেবে নিছিল ছেলে যদি কিছু না করে,পুলিশ ত আর এমনে এমনে ধরে নিয়ে যায় নি। তারা নিশ্চয় কিছু করেছে।শুধুমাত্র আমার পরিবার বিশ্বাস করত আমি কিছু করতে পারিনা, আমরা কিছু করিনি।
আমার আম্মু এসবে কোনদিন কান দেয়নি।আম্মু আর মামা প্রতিদিন,প্রতিরাত সব ধরনের চেষ্টা চালাইছেন শুধু আমার মুক্তির জন্য। এই সময় আমার পরিবার ছাড়া আমাদের পাশে কেউই ছিলনা। কারণ আশেপাশের তারাও মনে মনে ধরেই নিছিল এই ছেলে শহরে গিয়ে খারাপ পথ বেচে নিছিল।
যাক সে আরও অনেক কথা। এদিকে আবার আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পরীক্ষাও আর দেওয়া হইনি।বাকি ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বি এবং ডি ইউনিট যেটা ২৭ এবং ২৮ অক্টোবর হবে কিন্তু আমারা এখনো জেলে। ২০ অক্টোবর শুনলাম আমাদের হাইকোর্ট থেকে জামিন দেওয়া হইছে।তার মানে ঠিক ১-২ দিন পর জামিন পেপার জেলে চলে আসলে আমরা মুক্ত হবো, এই কারাবন্দি থেকে।কিন্তু তাও এই পেপার আসেনি।কেন আসেনি তা জানিনা।
আমার ২৭ তারিখ, রবিবার ‘বি’ ইউনিট এক্সাম, কিন্তু শুক্র, শনি জেল বন্ধ থাকে।তার মানে আমাদের ২৪ তারিখ মাস্ট বের হতে হবে। এই ২৪ তারিখ সারাদিন আমি বেলকনি তে দাড়াই ছিলাম, শুধু আমার নামটা একবার শুনার জন্য। কিন্তু কেউ ডাকেনি আমার নাম ধরে।৪ টা বাজলে গেট বন্ধ করে দিবে,তখন আর বের হইতে পারব না,কেউ ঢুকতেও পারবে না। ৪ টাও বাজল, আমাদের গেটও বন্ধ হই গেল।
আমি রুমে গেলাম।বললাম,আজ যদি আমি বের হইতে না পারি ” আমি খোদা নামে কেউ আছে তা আর বিশ্বাস করবো না”। বিশ্বাস করেন এটা বলার পর পর নিচ থেকে আমাদের নাম ধরে স্টাফ রা ডাক দিল। আমাদের জন্য থালা খুলে দিল।তারপর সে অনেক কাহিনী এর পর আমি, মাইন মুক্ত হলাম,স্বাধীন হলাম, রাস্তাই আম্মুর হাত ধরে হেটেছিলাম।
সেদিন আমি হইতো আবার জন্ম নিছিলাম। তারপর ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ পরীক্ষা ও দিছিলাম।২৮ তারিখ রেজাল্ট পেলাম, আলহামদুলিল্লাহ মেধা তালিকায় ৬৯৮তম ও হইছিলাম।সেদিন আমাকে জঙ্গি বলা মানুষদের ন্যারাটিভ ও চেঞ্জ হই গেছিল।যাক, সে অনেক কথা, বলতে গেলে উপন্যাস লেখা যাবে।
আমি আজকে ৬ বছর পর এসব কেন লিখতেছি? কারণ আজ আমি স্বাধীন,আজ আমাকে থামিয়ে রাখবে এমন কোন শক্তি নেই, নেই কোন মানবতা, শৃংখলতা, নেই কোন বাধা।
আমি আজকের এই স্বাধীন দিনে এই ফ্যাসিস্ট সরকার এবং এই সরকার এর সমর্থনগোষ্টীর কাছে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। “আমি কি অপরাধ করেছিলাম? আমাকে কেন শিবির ট্যাগ দেয়া হলো? আমাকে কেন জঙ্গি নামক নিকৃষ্ট শব্দ ইউজ করে মামলা দেয়া হলো? আমাকে কেন ৪০ দিন জেল কাটতে হইছিলো? আমাকে কেন এই ৬ বছর ধরে হাজিরা দিতে হচ্ছে?” আমি ৬ বছর ঘুমাইনি। আমার ভয় ছিল। তারা যদি আমাকে আবার নিয়ে যায়? আমাকে আমার ৬ বছর ফিরিয়ে দিতে পারবি?
লেখাঃ মোশাররফ হোসেন. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
❑ মুক্তকলাম থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুনঃ বৈষম্যের এই বীজকে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে বিষবৃক্ষ করার সুযোগ আছে-জি এম কাদের