আইসিটি ওয়ার্ল্ড নিউজ: অ্যালান ট্যুরিং: কম্পিউটার বিজ্ঞানের নীরব নায়ক । অ্যালান ট্যুরিং ছিলেন কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পিতা। তার ভাবনাগুলো আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছে। ট্যুরিং শুধু গণিতজ্ঞই ছিলেন না, তিনি এমন একজন যুগান্তকারী বিজ্ঞানী, যিনি বিশ্বযুদ্ধের সময় সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
শৈশব ও শিক্ষা:
অ্যালান ম্যাথিউ ট্যুরিং ১৯১২ সালের ২৩ জুন ইংল্যান্ডের লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তার গাণিতিক মেধা চোখে পড়ার মতো ছিল। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিং’স কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেন।
ক্যারিয়ার:
১৯৩৬ সালে তিনি “ট্যুরিং মেশিন” ধারণা উপস্থাপন করেন, যা পরবর্তীতে আধুনিক কম্পিউটারের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘Enigma’ কোড ভাঙার কাজ দেন। ট্যুরিং এবং তার টিম সফলভাবে জার্মান কোড ভেঙে যুদ্ধ জয়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
প্রযুক্তিতে অবদান
❁ ট্যুরিং মেশিন (১৯৩৬): ট্যুরিং তার বিখ্যাত গবেষণাপত্রে একটি কাল্পনিক যন্ত্রের ধারণা দেন, যাকে “ট্যুরিং মেশিন” বলা হয়। এটি ছিল তত্ত্বগত একটি যন্ত্র যা যেকোনো অ্যালগরিদম বা গণনার ধাপ-ধাপে কাজ করতে পারে। এই ধারণাই পরবর্তীতে আধুনিক কম্পিউটারের বুনিয়াদ হয়ে দাঁড়ায়।
❁ Enigma কোড ভাঙ্গা (১৯৪০-৪৫): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর Enigma নামক গোপন সংকেত ব্যবস্থা ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা Bletchley Park-এ ভাঙতে কাজ করেন ট্যুরিং। তাঁর তৈরি ‘বোম্বা’ নামক যন্ত্র Enigma কোড দ্রুত ভাঙতে সাহায্য করে, যা মিত্র বাহিনীর জন্য যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেয়।
❁ বিন্যাস ও ডিজাইন অব দ্য আর্লি কম্পিউটার: যুদ্ধ শেষে তিনি ইউনিভ্যাক এবং Manchester Mark I কম্পিউটারের নকশা এবং উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সময় ট্যুরিং কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মৌলিক ধারণাগুলো বিকাশ করেন।
❁ ট্যুরিং টেস্ট (১৯৫০): তিনি প্রস্তাব দেন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে মেশিনের বুদ্ধিমত্তা বিচার করা হয়। একটি মানুষ আর একটি কম্পিউটার যন্ত্রের সাথে আলাদা করে কথা বলে বুঝতে পারবে না মেশিন নাকি মানুষ, তাহলে ওই মেশিনকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বলা হবে। আজকের AI গবেষণায় এই টেস্টের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।
❁ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পথপ্রদর্শক: ট্যুরিংয়ের কাজ আধুনিক AI-এর ভিত্তি স্থাপন করেছে, বিশেষ করে যন্ত্র শেখানো, স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ভাষা বোঝার মতো ক্ষেত্রগুলোতে।
ব্যক্তি জীবন ও স্বীকৃতি
ট্যুরিং ছিলেন একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ, কিন্তু তিনি সমকামিতা নিয়ে সামাজিক ভীষণ হেনস্থার শিকার হন। ১৯৫২ সালে এই কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাঁকে রেডিয়েশন থেরাপি নিতে বাধ্য করা হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর অবদান অস্বীকৃত ছিল।
পরে ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তার প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ২০১৩ সালে তাঁকে রাজকীয় মুকুট দেওয়া হয়।
শেষ জীবন
১৯৫৪ সালের ৭ জুন অ্যালান ট্যুরিং গৃহেই মারা যান, মৃত্যুর কারণ বিষক্রিয়া বলে জানা যায়, যা আত্মহত্যা বলে বিবেচিত হয়।
অ্যালান ট্যুরিং একজন যিনি আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রবর্তক এবং যুদ্ধকালীন কোডব্রেকিংয়ের মহানায়ক। তার আবিষ্কার এবং তত্ত্ব আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ভিত্তি তৈরি করেছে। সমাজ তার প্রতি সম্মান জানাতে অনেক দেরি করলেও, ইতিহাস তাকে এক নিঃস্বার্থ বিজ্ঞানী ও বীর হিসেবে স্মরণ করবে।
❑ টেক হিরোজ থেকে আরও পড়ুন
আরও পড়ুন: ইন্টারনেট আবিষ্কার এবং বর্তমান যুগে এর গুরুত্ব